খুলনায় চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনায় গতকাল শুক্রবারও (৩ মার্চ) কর্মবিরতি পালন করছেন চিকিৎসকরা। ফলে নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক ও ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখার জন্য চিকিৎসকদের নেওয়া সাক্ষাৎ (অ্যাপয়েনমেন্ট) বাতিল করা হয়েছে। বুধবার (১ মার্চ) ভোর ৬টা থেকে শুরু হওয়া চিকিৎসকদের কর্মবিরতিতে সরকারি হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসা নিতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরাও প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না। এদিকে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা করতে খুলনায় আসছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। আজ শুক্রবার দুপুর আড়াইটার দিকে খুলনা বিএমএ ভবনে চিকিৎসক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তারা। সেখানে বিএমএ, ক্লিনিক মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল খুলনার পথে রয়েছে। দুপুর আড়াইটার দিকে তারা আমাদের সঙ্গে বিএমএ ভবনে বসবেন। যারাই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান আমরা তাদের সঙ্গে বসব। তবে আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক খুলনার বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী দেখেন। বৃহস্পতিবার রাতে কর্মবিরতিতে একাত্মতা পোষণ করে তারাও তাদের পূর্বনির্ধারিত অ্যাপয়েনমেন্ট বাতিল করেছেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার কর্মবিরতি প্রত্যাহার হবে এমন ধারণা থেকে অনেক চিকিৎসক শুক্রবার ব্যক্তিগত চেম্বারের রোগীদের সিরিয়াল নিয়েছিলেন, সেগুলোও বাতিল করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি শুক্রবার নগরীর ডক্টরস পয়েন্ট হাসপাতালে রোগী দেখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ মামুন। নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি রয়েছে তার। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই রোগীরা তার অ্যাপয়েনমেন্ট নেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনিও সকল অ্যাপয়েনমেন্ট বাতিল করেছেন। একইভাবে খ্যাতনামা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুহুল কুদ্দুসসহ আরও অনেকেই শুক্রবারের অ্যাপয়েনমেন্ট বাতিল করেছেন। প্রতি শুক্রবার তাদের পরামর্শ নিতে শতাধিক রোগী আবেদন করেন। চিকিৎসকরা জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরী বিএমএ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি রোগীদের দুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কর্মবিরতি প্রত্যাহারের নির্দেশনা দেন। এছাড়া বিএমএ’র কেন্দ্রীয় সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন খুলনা বিএমএ নেতাদেরকে কল করে একই নির্দেশনা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) বেলা ১১টায় শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল চত্বরে যে বিক্ষোভ সমাবেশ করার কর্মসূচি ছিল তা বাতিল করা হয়। পরে বেলা ১১টায় খুলনা বিএমএ কার্যালয়ে জরুরি সভা করেন চিকিৎসকরা। তবে ঊর্ধ্বতনদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারে নির্দেশ থাকলেও প্রায় ৪ ঘণ্টার সভায় কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। জরুরি সভা শেষে খুলনার বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম জানিয়েছিলেন, খুলনার শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলাকারী পুলিশের এএসআই নাঈমকে গ্রেপ্তার এবং দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে। এদিকে শনিবার (৪ মার্চ) দুপুর ১২টায় আবু নাসের হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওইদিন সন্ধ্যা ৭টায় বিএমএ কার্যালয়ে সংগঠনের জরুরি সাধারণ সভা করা হবে। ওই সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। ডা. শেখ বাহারুল আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করছে। চিকিৎসকের ওপর হামলাকারী পুলিশ সদস্য হওয়ায় তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। যদি তাদের দাবি পূরণ না হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি পেশ এবং প্রয়োজনে গণপদত্যাগ করার হুঁশিয়ারি দেন। সাতক্ষীরা জেলা পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, এএসআই নাঈম শেখকে জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন পুলিশের এএসআই নাঈমের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। তিনি শ্লীলতাহানি ও স্বামীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির জন্য ডা. নিশাত আব্দুল্লাহর কঠোর বিচার দাবি করেন। একইসঙ্গে তাদের অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি অনুরোধ জানান। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মিথ্যা মামলা দিয়ে আমার স্বামীকে হয়রানি ও আমার মেয়েকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তার ফলে আমার মেয়ের হাতের অবস্থার যে অবনতি হচ্ছে এই দায়ভার কে নেবে? চিকিৎসকদের অভিযোগ, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর একটি ক্লিনিকে ডা. নিশাত আবদুল্লাহকে মারধর করেন পুলিশের এএসআই নাঈম ও তার সঙ্গীরা। তার মেয়েকে ভুল চিকিৎসার কথা বলে এই হামলা চালানো হয়। এ হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার ডা. নিশাত বাদী হয়ে এএসআই নাঈমের বিরুদ্ধে সোনাডাঙ্গা থানায় মামলা করেন। অপরদিকে শ্লীলতাহানি ও শিশুর অঙ্গহানি করার অভিযোগ তুলে ডা. নিশাতসহ ২ জনের বিরুদ্ধে একই থানায় মামলা করেন পুলিশের এএসআই শেখ নাঈমের স্ত্রী নুসরাত আরা ময়না। এদিকে খুলনায় পুলিশ-চিকিৎসক দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে সরকার তথা প্রশাসনকে ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন খুলনা নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ। সংগঠনের পক্ষে আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ ফ ম মহসীন এবং সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, চিকিৎসকের ওপর পুলিশ তথা রোগীর লোকজনের হামলা। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, মামলা। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে বিনা চিকিৎসায় একের পর এক রোগীর মৃত্যু, মুমূর্ষ রোগীদের আর্তনাদ, চিকিৎসাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি। যা কারোই কাম্য নয়। উভয় পক্ষের মর্যাদা-শক্তি পরীক্ষার লড়াইয়ের ঘৃণ্য শিকার হচ্ছেন জনগণ। অথচ তাদের সকলের বেতন, বিলাসী জীবনের উৎস এই জনগণই। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে রোগীর লোক তথা ভুক্তভোগী নারীর উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু বিচারে বিভাগীয় তদন্ত প্রয়োজন। এদিকে চিকিৎসকের ওপর হামলা বা হামলার অভিযোগ আইন হাতে তুলে নেওয়ার শামিল কি না সেটিও বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বেআইনি ও অনৈতিক কাজের জের ধরে পরবর্তী স্বেচ্ছাচারী ভূমিকার কারণে জনগণকে ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বিবৃতিতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা অপরাধী হলে অবশ্যই তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। জনগণকে ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।