ফসলি জমে নষ্ট করে সরকারি-বেসরকারী কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া যাবে না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিন আগে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই নির্দেশনাও মানছে না রাজশাহীর প্রশাসন। সেই সুযোগে রাজশাহীতে ফসলি জমি নষ্ট করে চলছে পুকুর খননের মহোৎসব।
জেলার দুর্গাপুর, তানোর, মোহনপুর, বাগমারা এবং পুঠিয়ায় অর্ধশতাধিক পুকুর খনন চলছে গত কয়েকদিন ধরে। এতে অন্তত হাজারের অধিক বিঘা ফসলি জমি নষ্ট হবে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগ।
সবচেয়ে বেশি পুকুর খনন হচ্ছে রাজশাহীর দুর্গাপুরে। এ উপজেলা অন্তত ৫০০ বিঘা ফসলি জমি নষ্ট করে গত প্রায় ১৫ দিন ধরে চলছে পুকুর খননের কাজ। দিনের বেলা খনন কাজ বন্ধ রেখে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রাতে চলছে পুকুর খনন। ফসলী জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করার জন্য দুর্গাপুর উপজেলা সাধারণ কৃষকরা দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে একাধিকবার অভিযোগ দিয়েও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, তানোরের চান্দুড়িয়া বিলে রাজশাহী-তানোর রাস্তার একেবারে পাশে প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে চলছে একটি বিশালাকার পুকুর খননের কাজ। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে এ পুকুর খনন কাজ করছেন শাহীন নামের এক ব্যক্তি। ৫টি এক্সকেভেটর মেশিন দিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে চলে সকাল পর্যন্ত এ পুকুর খনন কাজ। দিনে বেলা বন্ধ রাখা হয় লোকচক্ষুর ভয়ে।
স্থানীয় হাবিবুর রহমান নামের একি ব্যক্তি বলেন, এ জমিতে প্রচুর ধান হয়। কিন্তু সেই জমি নষ্ট করে এখন পুকুর খনন করা হচ্ছে। এতে নষ্ট হয়ে গেল ধানি জমি। বেশি লাভের আশায় জমি মালিকরা জমি বিঘা প্রতি বছরে ৩০ হাজার টাকা করে নিয়ে বন্ধক করে পুকুর খনন করতে দিয়েছেন রাজশাহীর ব্যবসায়ী শাহিনের কাছে। তবে পুকুর খননের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত। তাই প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রশাসনও টাকা নিয়েছেন পুকুর খননের জন্য।’
জেলার দুর্গাপুরের আংরার বিলে গিয়ে দেখা যায়, এ বিলের চারিদিকে যেদিকে চোখ যাবে, সেদিকেই পুকুর আর পুকুর। গত ৭-৮ বছরে এ বিলে অন্তত তিন শতাধিত পুকুর গড়ে ঠঠেছে। এক সময়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসলে ভরে থাকতো যে বিল, সেটি এখন পুকুরে পুকুরে ভরে গেছে। তার পরেও থামেনি ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খননের কাজ। বিলে এখন সোহেল নামের এক ব্যক্তি ২০ বিঘা আয়তনের একটি পুকুর খনন করছেন গত প্রায় ১০ দিন ধরে।
এছাড়াও মিলন নামের এক ব্যক্তি ৭০ বিঘা, আলম নামের এক ব্যক্তি ৮০ বিঘা, ফারুক হোসেন ৩৫ বিঘা আয়তনের পুকুর খনন করছেন। এছাড়াও উপজেলার বাশাইল নেংড়াতলা এলাকায় তুহিন ৩০ বিঘা, আড়ইলে সোহেল ৫৫ বিঘা, গোপালপাড়ায় আশরাফ হোসেন ৪৫ বিঘা, সাকোয়া ফলির বিলে আণি ৩৫ বিঘা, নবি ২৫ বিগা, ভবানীপুর বিলে রেজাউল ৩০ বিঘা, মেখপাড়া গ্রামে রিগেল ১৫ বিঘা সুর্যভাগে শফিকুল ইসলাম ২০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন। সবকটি পুকুর রাতের বেলা কাটা হচ্ছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশকে ম্যানজে করে। একেকটি পুকুরের জন্য প্রশাসন ২-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশে একজন পুকুর খননকারী বলেন, উপলেজা প্রশাসনকে টাকা না দিলে পুকুর খনন করা যায় না। টাকা দিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। বিঘাপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে প্রশাসনকে।
এদিকে, গত ৭ ফেব্রুয়ারি দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ফসলি জমিতে পুকুর খনন বন্ধের দাবি জানিয়ে কিসমত গনকৈড় ইউনিয়নের উজানখলশী গ্রামবাসীর পক্ষে উজানখলসি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক সাইফুল ইসলাম লিখিত অভিযোগ করেন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। উল্টো পুকুর খননকারীরা আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে।’
কিশমত গনকৈড় ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘পুকুর খনন হচ্ছে। অভিযোগ করেও তো কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই রাতের আঁধারে পুকুর খনন চলছেই।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা. সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা পুকুর খননের বিরুদ্ধে অভিযান করছি। কিন্তু প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পুকুর খনন হচ্ছে এমন অভিযোগ সঠিক নয়। রাতের আঁধারে যেসব পুকুর খনন হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিব। পুকুর খকনের ফলে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। আমরা জমি রক্ষায় কাজ করছি।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে রাজশাহীতে অন্তত এক হাজার বিঘা ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খননকাজ চলছে। কিন্তু এসব নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে ফসলি জমি রক্ষা করতেও পারছি না আমরা।’