একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল কত ফুটবলারকে মহান করে দিয়েছে! আবার কতজনকে ইতিহাসের অন্ধকার পাতায় ঠাঁই দিয়েছে! দিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবদন্তি হয়ে গেছেন একটা বিশ্বকাপ জিতে। বিশ্বকাপ ট্রফি না থাকায় পুসকাস-ক্রুইফরা কত পেছনেই না পড়ে আছেন। ইতিহাসের সেরা ফুটবলারের খ্যাতি পেয়েছেন লিওনেল মেসি। এমন সব ম্যাচ উপহার দিয়েছেন, যা কেবল কিংবদন্তির কাছ থেকেই পাওয়া যায়।
তবে বিশ্বকাপ না থাকলে যেন সব গৌরব ম্লান হয়ে যায়! লিওনেল মেসি কী বিশ্বকাপ জয়ের গৌরবে দীপ্ত হবেন! নাকি কিলিয়ান এমবাপ্পের গতির কাছে থেমে যাবে আর্জেন্টিনা! কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আজ স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা) লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হচ্ছে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স। বিশ্বকাপের ট্রফি জয়ের শেষ সুযোগ লিওনেল মেসির। অন্যদিকে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাসে অমর হওয়ার অপেক্ষায় কিলিয়ান এমবাপ্পেরা।
বিশ্বকাপ ট্রফি জিতেছেন ফ্রান্সের অধিনায়ক হিসেবে। কোচ হিসেবেও বিশ্বকাপজয়ী। ইতিহাসে এমন কেবল আর একজনই আছেন। ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।
বিপরীত দিকে লিওনেল স্কালোনি। দেশমের তুলনায় অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেকটাই খালি। কিন্তু এই কোচের মাধ্যমেই আর্জেন্টাইনরা দেখছে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন স্কালোনিই। গত বছর কোপা আমেরিকা জয় করেছে তার দল।ব্রাজিলের মাটিতে। সে সময় ব্রাজিলকেই ফেবারিট ভেবেছিল সবাই। এবারেও ফ্রান্সকে ফেবারিট ভাবছে অনেকে। এমিলিয়ানো মার্টিনেজ তো বলেই দিলেন, ‘আমরা কোপা আমেরিকা জয়ের সময় ব্রাজিলকেই ফেবারিট ভেবেছিল সবাই। আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এখন ফ্রান্সকে ফেবারিট ভাবছে সবাই। তা ভাবতে থাকুক। আমরা নিজেদের খেলাটা খেলে চ্যাম্পিয়ন হতে চাই। ’
কে জিতবে বিশ্বকাপ? লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা নাকি কিলিয়ান এমবাপ্পের ফ্রান্স? কিন্তু খেলাটা কেবল দুজনের মধ্যে নেই। দুটো দলের মধ্যে। একটু ব্যাপকভাবে ধরলে লড়াইটা দুই দেশের মধ্যে। তাদের সমর্থকদের মধ্যে। কোটি কোটি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন মিশে আছে এ লড়াইয়ে। ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরিস যেমনটা বললেন, ‘মেসি ইতিহাসের সেরা ফুটবলার নিঃসন্দেহে। তবে এখানে খেলাটা হবে দুটো দলের মধ্যে। ব্যক্তিগত লড়াই নয় এটা। ’ আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স এর আগে ১২ বার মুখোমুখি হয়েছে ফুটবলে। ছয়বার জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা। ফ্রান্স জিতেছে তিনবার। তবে ২০১৮ সালে শেষ লড়াইয়ে ফরাসিরা জিতেছে ৪-৩ গোলে। সেই লড়াইয়ের একটা প্রভাব আজও থাকতে পারে! সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পারে আর্জেন্টিনা। আর সেই জয় থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে ফ্রান্স।
আর্জেন্টিনা প্রস্তুতি নিয়েছে সম্ভাব্য সেরা উপায়ে খেলার জন্য। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া খেলতে পারেন আজ ম্যাচের শুরু থেকেই। অন্তত তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন আর্জেন্টাইন কোচ। ডি মারিয়া নাকি এখন পুরোপুরিই ফিট। বিপরীত দিকে ফ্রান্স দলে বেশ কিছু সমস্যা আছে। অসুস্থতার তালিকায় রাফায়েল ভারানে এবং কোনাতের মতো তারকা ফুটবলাররাও আছেন। তারা অনুশীলনই করতে পারেননি শুক্রবার। তবে ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশম জানিয়েছেন, ২৪ জন ফুটবলার আছেন তার দলে। এদের মধ্য থেকেই দল গঠন করবেন তিনি।
ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতে সবার ওপরে আছে। এরপর জার্মানি ও ইতালির অবস্থান (দুই দলই চারবার করে বিশ্বকাপ জয় করেছে)। আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স ও উরুগুয়ে জিতেছে দুবার করে। আজ তৃতীয় বিশ্বকাপ জিতে এককভাবে তিন নম্বরে উঠে যেতে পারে আর্জেন্টিনা। সুযোগ আছে ফ্রান্সেরও।
ল্যাটিন আমেরিকায় বিশ্বকাপ ট্রফি সর্বশেষ নিয়ে গেছে ব্রাজিল। ২০০২ সালে জার্মানিকে হারিয়ে। এরপর টানা চারবার ইউরোপিয়ানরা বিশ্বকাপ জিতেছে। ২০০৬ সালে অল ইউরোপিয়ান ফাইনাল খেলে জিতেছে ইতালি। ২০১০ সালে অল ইউরোপিয়ান ফাইনাল খেলে জিতেছে স্পেন। ২০১৪ সালে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জার্মানি। ২০১৮ সালে অল ইউরোপিয়ান ফাইনালে জিতেছে ফ্রান্স। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এত লম্বা সময় ল্যাটিন আমেরিকার বাইরে থাকেনি ট্রফি। দীর্ঘ সময়ের এই খরা কি দূর করবেন লিওনেল মেসিরা! ল্যাটিন আমেরিকায় নিয়ে যাবেন বিশ্বকাপের ট্রফি!
আজকের ফাইনাল বেশ কয়েকটি রেকর্ড দেখবে। প্রথমত, লিওনেল মেসি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ড গড়বেন (২৬টি)। মেসি বিশ্বকাপের প্রায় শত বছরের ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টকারীও হতে পারেন! বিশ্বকাপ জিতে ফুটবল ইতিহাসে দিয়েগো ম্যারাডোনার মতোই অমরত্ব লাভ করতে পারেন তিনি। অন্যদিকে কিলিয়ান এমবাপ্পেও পেলের মতো তরুণ বয়সেই টানা দুটি বিশ্বকাপ জয় করার গৌরব অর্জন করতে পারেন। দিদিয়ের দেশম টানা দুই বিশ্বকাপজয়ী কোচ হতে পারেন। ইতালির ভিট্টোরিও পোজ্জোর পাশে নাম লেখাতে পারেন। পোজ্জো ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ সালে ইতালির কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয় করেছেন। রেকর্ড হতে পারে অনেক। কিন্তু কার ভাগ্য আজ প্রসন্ন! জানার জন্য অপেক্ষা বেশিক্ষণের নয়।
নবচেতনা / এমএআর