# লাতিন ফুটবলের উত্থান:
দক্ষিণ আমেরিকা, ১২টি দেশের বিশাল এক মহাদেশ। আমাজন, আতাকামা মরুভূমি কিংবা বলিভিয়ার সল্ট ফ্লাটের সৌন্দর্য্য ছাড়াও এই মহাদেশকে মানুষ চেনে আরেকটি জিনিসের মাধ্যমে, তা হলো ফুটবল। ছন্দময় লাতিন সৌন্দর্য্য মিশে থাকা এই মহাদেশের ফুটবল ফ্যান বিশ্বজুড়ে অগণিত। শত বছরেরও বেশি সময় ধরে ইউরোপের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার যোগ্যতা একমাত্র এই মহাদেশের দেশগুলোই দেখিয়েছে। কিন্তু কীভাবে এলো এখানে ফুটবল? যে মহাদেশ কি না যুগ যুগ ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল, তারাই কীভাবে উন্নত ইউরোপকে টেক্কা দেবার সাহস করেছে? আর এই দেশগুলোর এত সমর্থকই বা কীভাবে হলো? চলুন, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
পঞ্চাদশ শতকের শেষে ও ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে পর্তুগীজ আর স্প্যানিশদের আগমন ঘটতে থাকে দক্ষিণ আমেরিকার মাটিতে। মূলত স্বর্ণের দেশ ‘এল ডোরাডো’র খোঁজেই ইউরোপীয়দের পা পড়ে এখানে। ইউরোপীয়রা সাথে করে আনতো আফ্রিকান ক্রীতদাসদের। ইউরোপীয়ানরা আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আইরেসের বন্দর ‘রিও দে লা প্লাতা’ দিয়ে দক্ষিন আমেরিকায় প্রবেশ করে এবং আর্জেন্টিনা দেশটি দখল করে নেয়। তখন বর্তমান দেশ উরুগুয়েও আর্জেন্টিনার অংশ ছিলো(পরে ১৮২৮ সালে ব্রাজিলের সংগে যুদ্ধে উরুগুয়ে আলাদা হয়ে যায়)। ইউরোপীয়ানরা সদ্য দখলকৃত আর্জেন্টাইদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। জাতিগতভাবে আর্জেন্টাইনরা খুবই সহজ-সরল ছিলো এবং খুবই দরীদ্র থাকায় তারা ইউরোপীয়দের শ্রমিকে পরিনত হয়। আর্জেন্টাইন আদিবাসিদেরকে দিয়ে ইউরোপীয়ানরা ‘এল ডোরাডো’র স্বর্নের অনুসন্ধান করাতো যার খোঁজ পরবর্তীতে কখনোই পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে দক্ষিণ আমেরিকার এই বিশাল অঞ্চলটির দুইটি বড় অংশ আলাদা হয়ে স্প্যানিশ সামা্রাজ্য আর পর্তুগীজ সামা্রাজ্যের উপনিবেশে পরিনত হয়।
দীর্ঘ প্রায় তিনশো বছরের ইউরোপীয় শাষনে অতিষ্ঠ হয়ে ১৮১০ সালে আর্জেন্টাইনরা প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা দেয় এবং স্পেনীয় সাম্রাজ্যের সংগে যুদ্ধ শুরু করে। দীর্ঘকাল স্বাধীনতা যুদ্ধের পর লাতিন অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে ১৮১৮ সালে আর্জেন্টিনা দীর্ঘ ইউরোপীয় শাষন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে আর্জেন্টাইন বিপ্লবিদের সহযোগীতায় ১৯ শতকের দিকে একে একে চিলি, ব্রাজিল, পেরাগুয়ে এই দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও তখনও তারা ফুটবল দুনিয়ার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পায়নি।
পুরো দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে সর্বপ্রথম ফুটবলের আগমন ঘটে আর্জেন্টিনায়, ১৮৬০ এর দিকে ব্রিটিশ নাবিকদের মাধ্যমে। ব্রিটিশ কোম্পানি ও জাহাজ যখন আর্জেন্টিনার ‘রিও ডি লা প্লাটা’য় আসতো, তারা দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি নিয়েই এই অঞ্চলে আসতো। তাই অবসর সময় কাটানোর জন্য তারা সাথে করে আনে ফুটবল। বুয়েন্স আয়ার্স বন্দরে নোঙর করে নাবিকেরা ফুটবল খেলতেন। এখান থেকেই প্রথম ফুটবল খেলা স্বচক্ষে দেখার স্বাদ পায় স্থানীয়রা আর্জেন্টাইরা। ক্রমে ব্রিটিশ নাবিকদের সাথে স্থানীয় কিশোর তরুণেরা দলে ভাগ হয়ে খেলতে শুরু করে। তখন থেকেই স্থানীয়রা বুঝলো, এই গোলাকার বলটির মাঝে কোনো এক মোহনীয় শক্তি আছে।
আর্জেন্টাইরা ব্রিটিশদের সাথে দল ভাগ করে খেললেও তখন ব্রিটিশদের উচ্চতা ও সুঠাম দেহের সংগে পেরে উঠতো না দরিদ্র শ্রমিক আর্জেন্টাইরা। আর্জেন্টাইদের ফুটবলকে ব্রিটিশরা ”শ্রমিকের ফুটবল” বলে অভিহিত করতো। ব্রিটিশদের উচ্চতা ও সুঠাম দেহের সংগে না পেরে আর্জেন্টাইন তরুনরা ভিন্ন ধাঁচের এক নতুন ফুটবল আবিস্কার করলো। লাতিন ফুটবলের প্রধান সৌন্দর্য্য ড্রিবলিং সেখান থেকেই শুরু। অধিক উচ্চতার ব্রিটিশদের সাথে শুন্যে বল নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে তারা ছোট ছোট পাসে খেলে নিচ থেকে ড্রিবল করে ওপরে ওঠা, আর সুন্দর শটে ফিনিশিং করা নতুন ধরনের ফুটবল খেলতে শুরু করে। যা এখনো লাতিন ফুটবলের ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই নতুন কৌশলের ফুটবল তখন ব্রিটিশদের বেশ ভোগাতে শুরু করে। ব্রিটিশ-ইউরোপীয়দের পাওয়ার ফুটবল মাঝে মাঝেই আর্জেন্টাইন তরুনদের এই অসাধারণ সৌন্দর্য্যের কাছে হার মানতো। ব্রিটিশ-ইউরোপীয়ানরা তখন বেশ ধনী থাকায় তারা ফুটবলকে ধনীদের খেলা হিসেবে দেখতো এবং শ্রমিক আর্জেন্টাইনদের নতুন কৌশলেরর ফুটবলের কাছে হেরে যাওয়াকে ভালোভাবে গ্রহন করতে পারতো না।
১৮৬০-এর দিকে শুরু হওয়া এই শখের ফুটবল খুব দ্রুতই দরিদ্র আর্জেন্টাইদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিত্যদিনের খাবারের মতোই তাদের কালচারের অংশে পরিনত হয়। তখনও পর্যন্ত লাতিন অঞ্চলের অন্যদেশগুলোতে ফুটবল খেলা শুরু হয়নি। ১৮২৮ সালে ব্রাজিলের সঙ্গে যুদ্ধে উরুগুয়ে আর্জেন্টিনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তখনও ব্রাজিল, চিলি, পেরু সহ অন্যদেশগুলো ইউরোপীয় উপনিবেশ। দরিদ্র আর্জেন্টাইনরা ফুটবলকে তাদের ভাগ্য বদলের হাতিয়ার হিসেবে দেখতো। যার ফলশ্রুতিতে ১৮৬৭ সালে আর্জেন্টিনায় ‘’বুয়েন্স আয়ার্স ফুটবল ক্লাব’’ নামে দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম ফুটবল ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশ-ইউরোপীয়রা শ্রমিক আর্জেন্টাইন তরুনদের এই ক্লাবকে ভালো দৃষ্টিতে না নিলেও তখন ব্রিটিশ নাগরিক থমাস হগ এবং তার ভাই জেমস হগের এই ক্লাব প্রতিষ্ঠায় ভুমিকা ছিলো। ১৮৯৩ সালে প্রথম আর্জেন্টাইন লিগ চ্যাম্পিয়নশিপও অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি ব্রিটেন নিজেও তখনো সেভাবে ফুটবলের উন্নয়ন শুরু করেনি। বেলজিয়াম, সুইডেনের মতো পার্শ্ববর্তী দেশগুলো ক্লাব পর্যায়ের ফুটবলকে ঢেলে সাজানো শুরু করার পরই ব্রিটেন সেদিকে মনোযোগ দেয়। আর্জেন্টিনাতে লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার পর ঐ একই বছর আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হয়।
১৮৯৩ সালে আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন গঠন হলেও ব্রিটিশ-ইউরোপীয়রা এটাকে ভালোভাবে নেয়নি, আর্জেন্টাইদের লাতিন ছন্দময় ফুটবল ও কৌশলের ভয়ে তারা আর্জেন্টাইনদের খেলার আমন্ত্রন জানাতো না এবং নিজেরাও এসে খেলতো না। ফলে লাতিন অঞ্চলের একমাত্র ফুটবল খেলুড়ে দেশ হিসেবে আর্জেন্টাইনরা বাধ্য হয়ে নিজেদের মধ্যেই ফুটবল খেলতো। অত্যন্ত দরিদ্র দেশ আর্জেন্টিনারও সামর্থ ছিলোনা প্লেন ভাড়া দিয়ে ইউরোপে গিয়ে ফুটবল খেলার। ফলে অনেকবছর আর্জেন্টাইন ফুটবল নিজেদের ফুটবল কলাবগুলোর মধ্যেই আটকে থাকে।
পরবর্তীতে ১৯০১ সালে ‘আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ এর সহযোগিতায় উরুগুয়ে জাতীয় ফুটবল দল গঠন হয় এবং ১৯০১ সালের ১৬ই মে মোন্তেবিদেওতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে উরুগুয়ের আন্তর্জাতিক ফুটবলের অভিষেক হয়। ১৯১৪ সাল পর্যন্ত লাতিন আমেরিকার দুই দেশ আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে নিজেদের মধ্যেই ফুটবল খেলতে থাকে। এছাড়া এই দুইদেশের আর কোন উপায়ও ছিলোনা। যদিও ১৯১০ সালে ‘আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ এর সহযোগীতায় লাতিন অঞ্চলের তৃতীয় দেশ হিসেবে চিলি জাতীয় ফুটবল দলও গঠন করা হয় এবং আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে এনে ১৯১০ সালের ২৭শে মে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আর্তর্জাতিক ফুটবলে চিলিরও অভিষেক করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে চিলি অনেকদিন তাদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারেনাই।
১৯১৪ সালে ‘আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’ এর কর্মকর্তারা পার্শবর্তী লাতিন আরেক দেশ ব্রাজিলে যান ফুটবলের আরেকটি দেশ তৈরী করার উদ্দেশ্যে। যাতে তারা উরুগুয়ে ছাড়াও অন্য আরেকটি দলের সাথে খেলে তাদের ফুটবল ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে পারে। কর্মকর্তারা বিভিন্ন জেলা ও ক্লাবগুলো থেকে বেছে খেলোয়ার নিয়ে ব্রাজিল জাতীয় দল তৈরী করেন এবং তাদের সাথে করে আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে নিয়ে আসেন। ১৯১৪ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর বুয়েনোস আইরেসে ব্রাজিলের আর্তার্জাতিক ফুটবলের অভিষেক হয় আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। আর এভাবেই ফুটবল দুনিয়ায় আরো একটি নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়। লাতিন অঞ্চলের সবগুলো দেশেই ফুটবল ছড়ায় আর্জেন্টিনা থেকে এবং আর্জেন্টাইদের ভুমিকা ছিলো অপরিসীম। যদিও এর খেসারত আর্জেন্টাইদের বহু বছর দিতে হয় এবং ইউরোপীয়ানদের কুটকৌশলে আর্জেন্টিনা ৪টি বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারেনি। লাতিন ফুটবলের উত্থান মূলত এভাবেই হয়েছে এবং ধীরে ধীরে তা উন্নত ইউরোপকে টেক্কা দেবার সাহস করেছে।
১৯৩০ সালে ফিফা আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা এবং উরুগুয়ে ফাইনালে উঠে। প্রথম বিশ্বকাপেই ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয়ানদেরকে পিছনে ফেলে লাতিন দুই দেশ ফাইনালে উঠে। কিন্তু ফাইনাল শুরুর আগেই প্রতিবেশী দুই দেশের মাঝে বাঁধে বিপত্তি। আর্জেন্টিনার শক্তপোক্ত খেলোয়াড় লুইস মন্টি, যিনি মাঠে অন্যদের চেয়ে দ্বিগুণ জায়গা দখলে রাখতে পারতেন বলে ডাবল আঙ্কা (প্রস্থ) বলে পরিচিত ছিলেন তাকে উরুগুইয়ান সমর্থকরা হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি দিতে থাকেন। তিনি বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলছিলেন। তার নৈপুন্যেই সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা ওই আসরের হট ফেবারিট যুক্তরাষ্ট্রকে ৬-১ গোলে উড়িয়ে দুর্দান্তভাবে ফাইনালে আসে। কিন্তু ফাইনাল খেললে লুইস মন্টিকে মাটিতে পুতে ফেলার, দেশে জীবিত ফেরত যেতে না দেওয়ার হুমকি দিতে থাকেন উরুগুইয়ানরা। ম্যাচ হারলে রেফারি ল্যাংগুনেসকেও খুন করার হুমকি দেন উরুগুইয়ানরা। পরে উরুগুয়ে সরকারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি যেন শেষ বাঁশি বাজার পরপরই ওনারা নিরাপদে কোথাও চলে যেতে পারেন তাই বন্দরে একটা নৌকাও প্রস্তুত রাখার প্রতিশ্রুতিতে রেফারি ও আর্জেন্টিনা টিম মাঠে নামে এবং উরুগুয়ে ৪-২ গোলে শিরোপা জেতে।
এর পরের ইতিহাস আর্জেন্টাইনদের জন্য খুবই করুন। মোটা দাগে বলা হয় লাতিন ফুটবলের জনক আর্জেন্টিনাকে তারপর ফাইনাল খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ৪৮ বছর। কিন্তু এর পিছনে ইউরোপীয়ানদের আর্জেন্টাইনদের উপর নাখোশ ও চক্রান্ত ছিলো। আর্জেন্টিনা তখন খুব গরিব দেশ হলেও সবচেয়ে বেশী প্রতিভাবান ফুটবলার তৈরী ও ইউরোপে রপ্তানি করতো। সে সময় আর্জেন্টাইন ফুটবল শৈলী বা আধিপত্যকে আটকানোর জন্য ইউরোপীয়ানরা এই সুযোগটাই নিয়েছিলো। ইউরোপীয়ান ক্লাবগুলো হঠাৎ করেই আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের সাথে চুক্তি করলো, যে যে দেশের ক্লাবের হয় খেলে সে সে দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলতে হবে নইলে টাকা পাবে না।
সহজ সরল আর্জেন্টাইনরা প্রথমে বুঝতেই পারেনি। যে কারনে প্রথম বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক থাকা লুইস মন্টি, ওরসি এবং গুয়াতিয়াই পরের বিশ্বকাপে বাধ্য হন ইতালিরর হয়ে খেলতে এবং ইতালির হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বকাপের শিরোপা জেতেন। এমনকি আলফ্রাডো ডি স্টেফানো যাকে মারাদোনা আসার আগে পেলের চেয়েও বিশ্বসেরা ফুটবলার হিসেবে ধরা হতো তিনিও কখনো আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি। অথচ সেই সময়ে তিনি রিয়াল মাদ্রিদকে টানা পাঁচবার ইউরোপিয়ান কাপ জিতিয়েছিলেন। ওমর সিভোরির মতো ফুটবলার যিনি জুভেন্টাসকে টানা কাপ জিতিয়েছিলেন তিনিও আর্জেন্টিনার হয়ে কখনো বিশ্বকাপ খেলতে পারেননি ক্লাবগুলোর ব্লাকমেইলিংয়ের কারনে। আর্জেন্টিনার একাদশ সাজানোর মতো খেলোয়ারই ছিলোনা। এর প্রতিবাদে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ বয়কট করলো। ২০ বছর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপই খেলেনি।
ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর এই ব্লাকমেইলিং প্রথম বুঝেছিলেন বামপন্থি বুদ্ধিজীবি মেনত্তি। তিনি সমাজতত্ত্বের সাথে ফুটবলকে মিলিয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলকে এই ধারাবাহিক চক্রান্ত থেকে বের করার উপায় খুঁজলেন। তিনি ১৯৭৮ বিশ্বকাপের আগের দুই বছরের জন্য আর্জেন্টাইন ফুটবলারদের বিদেশে ক্লাবে ট্রান্সফার বন্ধ করে দিলেন। ফলস্বরুপ ১৯৭৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা আবারও ফাইনালে উঠে এবং চ্যাম্পিয়ান হয়।
# ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বৈরিতা কেন?? বাংলাদেশেই বা কিভাবে এলো??
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বৈরীতার কারন জানতে আবারও যেতে হবে ইতিহাসের বহু পিছনে। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইতিহাসে। সময়টা ১৮২৫ সাল। তখন ব্রাজিল ছিলো পর্তুগিজ উপনিবেশ এবং আর্জেন্টিনা তখন তিন শতাব্দির স্পেনীয় শাষন থেকে দীর্য স্বাধীনতা যুদ্ধ করে সদ্য স্বাধীন (১৮১৮) হওয়া যুদ্ধবিধ্ধস্ত দেশ। ১৮২৫ সালে সদ্য স্বাধীন আর্জেন্টিনার সিস-প্ল্যাটাইন অঞ্চল ব্রাজিলিয়ানরা দখন করে নেয় পর্তুগিজদের সহায়তায়। সদ্য স্বাধীন (১৮১৮) যুদ্ধবিধ্ধস্ত দেশ আর্জেন্টিনা আবারও যুদ্ধ শুরু করে ব্রাজিলিয়ান এবং পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে নিজেদের হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারে। প্রায় ২ বছর ৮ মাসব্যাপী চলে এই ভয়াবহ যুদ্ধ যা ইতিহাসে সিস-প্ল্যাটাইন যুদ্ধ বা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা যুদ্ধ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের সমঝোতায় ১৮২৮ সালে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং দক্ষীন আমেরিকা অঞ্চলে উরুগুয়ে নামের একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পরবর্তীতে ১৯ শতকের শুরুর দিকে ব্রাজিলের স্বাধীনতায় আর্জেন্টাইনদের ব্যাপক ভুমিকা থাকলেও এবং ব্রাজিল আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর্জেন্টাইনদের হাত ধরে আসলেও এই যুদ্ধের রেশ কখনোই কাটেনি। এই যুদ্ধ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বৈরিতার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কারন হলেও পরবর্তীতে তা ফুটবল দ্বৈরথে রুপ নেয়।
ফুটবলীয় কিছু ঘটনাও পরবর্তীতে প্রতিবেশী এই দুই দেশের পুরনো বৈরিতাকে আরও বৃদ্ধি করেছে। এর শুরু মূলত ১৯২৫ সালের কোপা আমেরিকার ম্যাচ থেকে। তখন ফুটবলে আর্জেন্টিনা পরাশক্তি হলেও ব্রাজিল ততোটা শক্ত দল হয়ে উঠেনি। তারপরও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচ হলেই ষ্ট্যাডিয়ামে সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তো সিস-প্ল্যাটাইন যুদ্ধের তিক্ত স্মৃতির কারনে। মাঠে খেলোয়ার এবং গ্যালারীতে দর্শকরাও যুদ্ধাংদেহী মনোভাবে হাজির হতেন। ওই ম্যাচের প্রথমার্ধে ব্রাজিলের একটা চমৎকার কাউন্টার এটাক ঠেকিয়ে দেন আর্জেন্টাইন এক ডিফেন্ডার। ব্রাজিলের ওই ফরোয়ার্ড সেটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সাথে সাথেই আর্জেন্টিনার সেই ডিফেন্টারকে সজোরে লাথি মেরে বসেন। আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডারও সাথে সাথে ব্রাজিল ফরোয়ার্ডকে ঘুষি মারেন। তারপরই মাঠে দুই দলের খেলোয়ারদের মধ্যে এবং গ্যালারিতে সমর্থকদের মধ্যেও ব্যাপক সংঘর্ষ মারামারি লেগে যায়। পরে বিপুল পরিমান পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে বাধ্য হয় এবং এই সংঘর্ষের পর আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল পরবর্তী ১১ বছর কেউ কারো সঙ্গে খেলেনি। এটাই ইতিহাসে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ম্যাচে প্রথম কোন সংঘর্ষের ঘটনা।
দীর্ঘ ১১ বছরের বিরতির পর ১৯৩৭ সালের কোপা আমেরিকায় আবারও মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। ওই ম্যাচে এক পর্যায়ে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে গেলে ব্রাজিল ২য় গোলটি মানতে পারেনি। রেফারির সিন্ধান্তের বিরোধীতা করে ব্রাজিল দল নির্ধারিত সময়ের আগেই মাঠ ছেড়ে চলে যায়। তারপরই গ্যালারিতে আবারও দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করে।
এরপর ১৯৩৯ সালে আবারও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল মুখোমুখি হয়। সেই ম্যাচেও ঝামেলা হয়। নির্ধারিত সময়ে খেলা ২-২ গোলে ড্র থাকলেও রেফারি একেবারে শেষ সময়ে ব্রাজিলকে একটা পেনাল্টি দেন কিন্তু আর্জেন্টিনা সেটা মানতে না পেরে মাঠ ছেড়ে চলে যায়। আর্জেন্টিনা মাঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পেনাল্টিতে ফাকা পোষ্টে গোল দিয়ে ব্রাজিল ওই ম্যাচ ৩-২ গোলে জিতে। কিন্ত বিপত্তি বাঁধে গোল করার পর ব্রাজিলিয়ানদের উল্লাসের ধরনে। গ্যালারি থেকে আর্জেন্টাইন সমর্থকরা ব্রাজিলিয়ানদের বর্ন-বিদ্বেষী আক্রমন শুরু করে। তারা ব্রাজিলিয়ানদের বন্য, বানর, কৃষ্ণাঙ্গ বলে কটাক্ষ করতে থাকেন। এতে দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।
সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ঘটে ১৯৪৫ সালের কোপা আমেরিকার ম্যাচে। চরম উত্তেজনাপূর্ন ম্যাচে ২৮তম মিনিটে ব্রাজিলিয়ান প্লেয়ার রোজা পিন্টো রাগ নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক হোসে সলোমনকে সজোরে লাথি মেরে বসেন। লাথির তীব্রতা এতোটাই ছিলো যে তখনই সলোমনের পায়ের টিবিয়া ফিবুলা(পায়ের শিন বোন) ভেঙ্গে যায়। এরপরই মাঠে দুই দলের খেলোয়ার এবং গ্যালারিতেও সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ লেগে যায়। ওই ম্যাচের ওই ২৮ মিনিটই হোসে সলোমনের জীবনের শেষ ম্যাচ ছিলো। তিনি আর কখনোই মাঠে নামতে পারেননি। ওখানেই তার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। এই ঘটনার পর আবারও পরবর্তী ১০ বছর এই দুই দল কেউ কারো সঙ্গে ম্যাচ খেলেনি। সিস-প্ল্যাটাইন যুদ্ধ এবং এই চারটি ঘটনাই মূলত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল বৈরিতা ও ফুটবল দ্বৈরথের কারন বিবেচনা করা হয়।
# ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বৈরিতা বাংলাদেশে কিভাবে এলো:
১৯৫০-৬০ এর দশকে এ অঞ্চলে আর্জেন্টিনা বিখ্যাত বিপ্লবি যোদ্ধা চে গুয়েভারার দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। তখনও ফুটবল টিভি সম্প্রচারের ব্যবস্থা না থাকায় এ অঞ্চলের ফুটবল তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি বা ভীনদেশী ফুটবলের সমর্থকগোষ্ঠী তৈরী হয়নি। দীর্ঘ ব্রিটিষ শাষনের দুঃসহ তাজা স্মৃতি এবং ব্রিটিষবিরোধী মনোভাব এ অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে চে গুয়েভাবার একচেটিয়া পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সফল বিপ্লব ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরী করে এবং পৃথিবীর অপর প্রান্তের লাতিন দেশ আর্জেন্টিনার সঙ্গে পরিচয় করায়।
৭০ এর দশকে ফুটবল বিশ্বকাপ টিভিতে সম্প্রচার শুরু হলেও বাংলাদেশে টেলিভিশন ও সেটেলাইট এভেইলেবল হয় ৮০’র দশকের শেষের দিকে। তখন এদেশে পেলে, ব্রাজিল বা ভীনদেশী কোন ফুটবলের ভক্ত ছিলোনা। ৭০ ও ৮০’র দশকে ওয়ার্ল্ড ফুটবলের সবচেয়ে বড়ো তারকা ছিলেন ‘দিয়েগো মারাদোনা’। ফুটবলের প্রথম সুপারষ্টারও বলা হতো তাকে। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমেই মাত্র ১৭ বছর বয়সেই মারাদোনা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দামী (৫ মিলিয়ন ইউরো ও ৭ মিলিয়ন ইউরো, যা ওই সময়ের বিশ্ব রেকর্ড ছিলো) ও সবচেয়ে আলোচিত সুপারষ্টারে পরিনত হন। আর্জেন্টিনার ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ও এদেশে আর্জেন্টাইন ফুটবলের সমর্থক তৈরীর বড়ো ফেক্টর ছিলো।
তবে ১৯৮২ সালের আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ডের ফকল্যান্ড যুদ্ধ, ব্রিটিষদের বিরুদ্ধে আর্জেন্টাইনদের দীর্ঘ সংগ্রাম ও ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে মারাদোনার ২ গোলে ইংরেজদের ২-১ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেওয়া এই অঞ্চলে মারাদোনার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও আর্জেন্টিনার ছন্দময় ফুটবলের স্থায়ী সমর্থকগোষ্ঠী তৈরী করেছিলো। মারাদোনার এক দশক ধরে মন্ত্রমুগ্ধ ফুটবলশৈলীর পাশাপাশি বি্রটিশবিরোধী মনোভাবও এর অন্যতম কারন ছিলো। যে কারনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে মারাদোনা করা অনৈতিক প্রথম গোলটি যা “হ্যান্ড অফ গড” নামে খ্যাত তাও এ অঞ্চলের মানুষ গর্বের সাথেই নিতো। আর মারাদোনা করা দ্বিতীয় গোলটিতো ফিফার ভোটে শতাব্দির সেরা গোল নির্বাচিত হয়েছিলো। ৬০ মিটার দূর থেকে একা ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ রক্ষণভাগের খেলোয়াড়কে কাটিয়ে দুর্দান্ত শটে গোল ফুটবল ভক্তদের আজীবন মনে থাকবে। ১৯৮৬ তে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ান হওয়ার পর ১৯৯০ বিশ্বকাপেও মারাদোনার নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলে তাই ১৯৯৪ বিশ্বকাপ পর্যন্তও বাংলাদেশে অন্যকোন দেশের স্থায়ী সমর্থকগোষ্ঠী ছিলো না।
বাংলাদেশে ব্রাজিলের সমর্থক তৈরী হয় মূলত ১৯৯৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতার পর। তবে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে রোনাল্দো নাজারিও, রিভালদো, কাফু, রবার্তো কার্লোসদের সময় এসে বাংলাদেশে ব্রাজিল ফুটবলের সমর্থক ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় যা এখনও চলমান।
লেখক : আশিক ফারুকী। প্রতিষ্ঠাতা, থ্যাঙ্ক ইউ ফাউন্ডেশন।
(লেখাটি ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেয়া)