সুস্থ ধারার সবচেয়ে বড় সর্বজনীন উৎসব বিশ্বকাপ ফুটবল। তবে এই মহোৎসবে মাঝেমধ্যেই পড়ে কালো ছায়া। গোলাবারুদ-ট্যাঙ্ক-ফাইটার প্লেন সর্বোপরি অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্যে মাঝেমধ্যেই থমকে যায় ফুটবল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল) কারণে বিশ্বকাপের দুই দুটো আসরে ছেদ পড়ে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য ১৯৪২ ও ১৯৪৬ সালের দুটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। এই যুদ্ধের বড় একটা প্রভাব পড়ে ইউরোপের ফুটবলেও। যুদ্ধের কারণে ইউরোপিয়ান ফুটবলের অবকাঠামো অনেকটাই ভেঙে পড়ে। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সর্বনাশা খেলা শুরু হয় যুদ্ধের আগে থেকেই। এর প্রভাব পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে। ১৯৩৬ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত ফিফার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ফিফার জন্মস্থান ফ্রান্সে বিশ্বকাপ আয়োজনের। ১৯৩৪ বিশ্বকাপ এবং ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ফিফা চেয়েছিল পরের বিশ্বকাপটা নিরাপদে আয়োজন করার। এ কারণে বেছে নেওয়া হয় ফ্রান্সকে। তবে টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপে বিশ্বকাপ আয়োজন মেনে নিতে পারেনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। ক্ষেপে যায় আর্জেন্টিনা। আয়োজক হতে না পেরে বিশ্বকাপেই অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বকাপের মতো তৃতীয় বিশ্বকাপের আয়োজক নিয়ে আপত্তি তোলে উরুগুয়ে। শেষপর্যন্ত তারা অনুপস্থিত থাকে। স্পেনজুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আগেই। ওই বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে স্পেন। হিটলারের চাপে বাছাই পর্ব থেকে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পরও নাম প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় অস্ট্রিয়া। বিশ্বকাপের ঠিক আগেই অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সঙ্গে একীভূত করে নেন হিটলার। জার্মানির সঙ্গে এক হয়ে বিশ্বকাপে খেলার সিদ্ধান্ত দেয় হিটলার। অস্ট্রিয়ার অধিকাংশ ফুটবলারকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয় জার্মান দলে। তবে স্বাধীনতা হারানোর কারণে প্রতিবাদী ছিলেন অস্ট্রিয়ার তারকা ফুটবলার ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার। জার্মানির হয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
বিশ্বকাপ ফুটবল মাঠে যুদ্ধের প্রভাবের বড় ঘটনার সাক্ষী ১৯৮৬ বিশ্বকাপ। যার পেছনের ঘটনাটি ছিল ঐতিহাসিক ফকল্যান্ড যুদ্ধ। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধে জড়ায় আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাজ্য। ১৯৮২ সালের ২ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত এই যুদ্ধ চলে। ২ মে ব্রিটিশ একটি ডুবোজাহাজ যুদ্ধ-অঞ্চলের বাইরে আর্জেন্টিনার জেনেরাল বেলগ্রানো নামের ক্রুজার জাহাজটি ডুবিয়ে দেয়। এতে ৩৭০ জন আর্জেন্টাইন প্রাণ হারান। এই যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হয়।
১৯৮৬ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড। ম্যাচে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। জোড়া গোল করেন ম্যারাডোনা। হেড করার বদলে হাত দিয়ে প্রথম গোলটি করেছিলেন ম্যারাডোনা। যেটি ‘হ্যান্ড অব গড’ নামে খ্যাত। ওই ম্যাচে ম্যারাডোনোর দ্বিতীয় গোলটি সর্বকালের সেরার মর্যাদায় উন্নীত। নীরবে ফকল্যান্ড যুদ্ধের যেন প্রতিশোধই নিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ‘হ্যান্ড অব গড’ তথা ওই ম্যাচ নিয়ে ম্যারাডোনা অসংখ্যবার বলেছেন, ‘ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টাইনবাসীর মধ্যে যে দুঃখ দিয়েছে ব্রিটিশরা, আমি সেটাই ওদেরকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।’
এশিয়ান ফুটবলেও যুদ্ধের প্রভাব রয়েছে বড় আকারে। এশিয়ার দেশ হিসেবে ফুটবল বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দুই প্রতিবেশী দেশ ইরাক ও ইরান। এই দুই দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় এর প্রভাব পড়ে তাদের ফুটবলেও। দীর্ঘ আট বছর ধরে এক মরণক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয় এই দুই দেশ। যে সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করেছিল দুই দেশ তাতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। ১৯৭৮-এর বিশ্বকাপে একমাত্র এশিয়ান প্রতিনিধি ছিল ইরান। কিন্তু ১৯৮২ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি তারা। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইরান সুযোগ পেলেও তাদের পারফরম্যান্স ছিল হতাশজনক। গ্রুপ পর্বের সব ম্যাচেই হেরে বিদায় নেয় ইরান। রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় বিশ্বকাপে। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক অবরোধের মুখে পড়ে ইরান। বিশ্বকাপে একই গ্রুপে পড়ে দুই দল। যেখানে মুখোমুখি লড়াইয়ে ২-১ গোলে ইরানের কাছে হার মানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে ফুটবল মাঠে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচ না খেলার সিদ্ধান্ত নেয় পোল্যান্ড। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়া নাম নিয়ে পুতিনের দেশ কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে মাঠে নামতে পারবে না। তাদের খেলতে হবে ‘ফুটবল ইউনিয়ন অব রাশিয়া’ নামে। এই বিশ্বকাপে রাশিয়া শুধুই দর্শক। এখানেই শেষ নয়, ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশে অনুষ্ঠিত হবে না কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ। বিদেশের মাটিতে ফুটবল ম্যাচে নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাশিয়ার জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত। ফিফা আরও জানিয়েছে, ইউক্রেন পরিস্থিতির অবনতি হলে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে পুরোপুরিই নিষিদ্ধ করা হবে রাশিয়াকে।
নবচেতনা /এমএআর