প্রণোদনার দাবি জলাবদ্ধতায় কয়রায় সহস্রাধিক বিঘা জমির আমনে ক্ষতি
অনাবৃষ্টির মধ্যেও জলাবদ্ধতায় খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ দেয়াড়া মৌজার (লক্ষীখোলা ও দেয়াড়া বিল) সহস্রাধিক বিঘা জমির রোপিত আমন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি খাল থাকতেও পানি সরবরাহের সুযোগ না দেওয়ায় এ পরিণতি হয়েছে। বিগত তিন/চার বছর জলাবদ্ধতায় ফলন ভালো হয়নি। লোকসান এড়াতে চলতি বছর অনেকেই আমন রোপন না করে ফেলে রেখেছেন জমি। উৎপাদন খরচ তুলতে না পেরে চাষের আগ্রহ হারাচ্ছেন এক ফসলি ওই জমির ওপর নির্ভরশীল চার শতাধিক পরিবার। অনেকে নিজ জমির ধান ফেলে রেখে জীবিকার সন্ধানে অন্যের জমির ধান কাটতে যাচ্ছেন দূর-দূরান্তে। সরেজমিন রবিবার লক্ষীখোলা ও দেয়াড়া বিলে যেয়ে দেখা যায়, প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমিতে কোন ধান গাছ নেই। যেখানে রোপন করা হয়েছে সেখানেও ধান গাছ লম্বা ও গোছ মোটা হয়নি। কিছু স্থানে ধান গাছ একটু ভালো হলেও কারেন্ট পোকায় নষ্ট করে দিচ্ছে। ধানে থোড় আসা শুরু করেছে। পোকা নিধনে কওসার গাজী নামের এক চাষিকে বিষ প্রয়োগ করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ৫ বিঘা জমিতে ধান রোপন করি। জলাবদ্ধতায় তেমন ভালো হয়নি। এরই মধ্যে পোকায় আরও ক্ষতি করছে। খরচ উঠানোর জন্য প্রাণপন চেষ্টা করছি। সেখানে কথা হয় সৈলুদ্দীন সানা, সালাম, শাহিনুর, জাহিদুলসহ কয়েকজন চাষির সাথে। তারা জানান, সামান্য বৃষ্টিতে ও নোনা পানি উঠে জলাবদ্ধতায় তাদের বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। পানি কমে গেলে ২/৩ কিলোমিটার দূর থেকে চারা কিনে রোপন করেন। নিয়মানুয়ায়ী সার-কীটনাশক দেয়া হয়। রোপনের কিছুদিন পর প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফের রোপিত চারা গাছ ডুবে যায়। চারা নষ্ট হওয়ায় অনেকে পুনরায় রোপন করেছেন। বিঘা প্রতি মোট ৮/৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তারা আরও জানান, কোন কোন চাষির ধান কাটার খরচও উঠবে না। তারা আর ফসলের খোঁজ রাখছেন না। কেউ কেউ বিঘা প্রতি ৬/৭ মণ ধান পেতে পারে। তবে অধিকাংশ চাষি বিঘা প্রতি ৩/৪ মণ ধান পেতে পারে বলে তাদের ধারণা। পানি সরবরাহের সু-ব্যবস্থা করতে মাদারবাড়িয়ার গেট উন্নতসহ ‘বেড়ের খাল’ উন্মুক্ত রাখার দাবি জানান তারা। পশ্চিম দেয়াড়ার আব্দুল হাই বলেন, বয়স বেড়েছে। বাইরে কাজে যেতে ইচ্ছে হয় না। নিজের জমির সাথে কিছু জমি বর্গা নিয়ে ধান লাগিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম বছরের খোরাক হয়ে যাবে। তবে ধানের অবস্থা ভালো না। অবশেষে খোরাকী জোগাতে এবছরও গোপালগঞ্জে ধান কাটতে যেতে হচ্ছে। একই গ্রামের তৈয়েবুর রহমান নামে এক চা বিক্রেতা বলেন, আমাদের ৪ বিঘা জমি রয়েছে। সেখান থেকে আগে বছরের অধিকাংশ খোরাকী হয়ে যেত। তবে বিগত ৩/৪ বছর ফলন ভালো হয়না। খরচও ওঠে না। এজন্য ধান লাগাতে পারিনি। দেয়াড়া গ্রামের মিলন বলেন, লক্ষীখোলা বিলে আমার পরিবারের প্রায় ১০ বিঘা জমি রয়েছে। বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ও পানি সরানোর ব্যবস্থা না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে ধান রোপন করিনি। পাশের দেয়াড়া বিলে ১২ বিঘার মত রোপন করেছি। তবে খরচ উঠবে বলে মনে হয় না। একই এলাকার সৈলুদ্দিন সানা নামের এক দিনমজুর জানান, লক্ষীখোলা বিলে ২ বিঘা জমি আছে। গত কয়েক বছর খরচ না ওঠায় এ বছর ফেলে রেখেছেন। তাদের কেউ খোঁজ রাখেন না। মাটি কেটে টাকা আয় করে ধান লাগানোর পরে যদি খরচ না ওঠে তখন খুব খারাপ লাগে, জানান তিনি। রুহুল কুদ্দুস নামের এক কৃষক বলেন, ৫ বিঘা জমিতে ধান রোপন করেছেন। বাগালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কালভার্ট বেধে দেওয়ায় ‘বেড়ের খাল’ হয়ে হোগলা গেট দিয়ে ছাড়া পানি সরানোর আর কোন পথ নেই। বেড়ের খাল সরকার ইজারা দিয়েছে। সেখান দিয়েও পানি সরানোয় বেগ পেতে হয়। ‘বেড়ের খাল’ উন্মুক্তের পাশাপাশি হোগলায় স্লুইজ গেট স্থাপনের দাবি জানান তিনি। মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, ওই বিলে ধান চাষের মাধ্যমে দারিদ্র এ এলাকার অনেকের রুটি-রুজী জোগাড় হয়। খাল ইজারা দেওয়ায় পানি সরবরাহে বাধাগ্রস্ত হয়। শেষের দিকে এসে কৃষকদের সাথে নিয়ে ইজারাদারের সাথে কথা বলে পানি সরানোর ব্যবস্থা করি। তবে তাতে সুফল মেলেনি। হাজারো জনগণের স্বার্থে খালের ইজারা বাতিল করে উন্মুক্ত করতে সরকারের সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু লক্ষীখোলা কিংবা দেয়াড়া নয়, উপকূলীয় কয়রা উপজেলার অধিকাংশ চাষিরা আমনের ফলন নিয়ে চিন্তিত। তবে তাদের সমস্যা জলাবদ্ধতা নয়। অনাবৃষ্টির ফলে পানির অভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। সেচ দিয়ে পানির ব্যবস্থা করতে খরচ বেড়ে যায়। দেরিতে রোপন করায় গাছে কেবল থোড় আসা শুরু হয়েছে। ঘরে তুলতে এখনও এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। গাছ ভালো হলেও বিভিন্ন পোকার আক্রমণে চিন্তিত তারা। মাত্র ৩/৪ শতাংশ চাষির ধান কাটার উপযুক্ত হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কয়রা উপজেলায় চলতি বছর ১৫ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। গেল বছর ১৪ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদে ৩৩ হাজার ৪২ দশমিক ৩৬ মেট্রিক টন (চাল) উৎপাদন হয়। কয়রা উপজেলার মহারাজপুর ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এসএম ফারুক হোসেন বলেন, লক্ষীখোলা ও দেয়াড়া বিলের বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। খাল উন্মুক্ত করা গেলে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব। মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, নোনা পানি প্রবেশ করায় বাগালীর চেয়ারম্যান তাদের কালভার্ট বন্ধ করে দেয়। মাদারবাড়িয়া গ্রামস্থ কয়রা-চাঁদআলী সড়কের গেট উন্নতসহ ‘বেড়ের খাল’ উন্মুক্ত করা গেলে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কয়রা উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা অসিম কুমার দাস বলেন, কারেন্ট পোকাসহ অন্যান্য কিছু পোকা আক্রমণের খবর পেয়েছি। পোকা দমনে উঠান বৈঠক ও লিফলেট বিতরণের পাশাপাশি চাষিদের সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। তবে জলাবদ্ধতায় আমনে ক্ষতির বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে এ প্রতিবেদককে বলেন।