উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। মধ্যরাত থেকে হালকা বৃষ্টি হলেও সোমবার দুপুরের পর থেকে মুষলধারায় রূপ নেয়। নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে চরম আতঙ্কে রয়েছে প্রকৃতিক দুর্যোগে বার বার বিধ্বস্ত খুলনার কয়রা উপজেলার জনপদ। তবে ঝড়ের চেয়েও নদী ভাঙ্গনের আতঙ্ক বেশি বিরাজ করেছে মানুষের মধ্যে। এছাড়া নদীর চরে বসবাসকারী আশ্রয়ন প্রকল্পের সুবিধাভোগীসহ বিভিন্ন স্থানের বেশ কিছু পরিবার চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সন্ধ্যায় সাইক্লোন শেল্টার গুলোতে মানুষ আসতে শুরু করেছে। এদিকে উপজেলার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরী নামক স্থানে সোমবার ভোরে বাঁধে ভাঙন দেখা দিলেও সংস্কারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোন ভূমিকা দেখা যায়নি। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে সেখানে কিছুটা সংস্কার করলেও ঝুঁকি কাটেনি। খুলনার কয়রা উপজেলা, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড -২ এর আওতায়। বাঁধ ও পানি বৃদ্ধির বিষয় জানতে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহনেওয়াজ তালুকদারকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় মিডিয়ার কারো ফোনই তিনি দুই দিন ধরে রিসিভ করছেন না। সোমবার বেলা ১১টায় সরেজমিন কয়রার কপোতাক্ষ নদের পাড়ের গোবিন্দপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে একটি খুপড়ির মধ্যে ছেলেকে নিয়ে গৃহবধু বেবি খাতুন বসে আছেন। তিনি বলেন, স্বামী সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে গেছে এক সপ্তাহ আগে। এখন কোথায় আছে জানেন না তিনি। মোবাইলে কল ঢুকছে না। তিনি জানান, ঝড়ের কথা শুনলে গা শিউরে ওঠে। ঝড় ঝাপটাতে নদীর তীরে অবস্থান করতে হয়। যাওয়ার কোন জায়গা নেই। বেশি সমস্যা হলে পাশের স্কুলে যেয়ে থাকেন। সেখানে আরও ৩/৪ টি পরিবারের দেখা মেলে। পরে সাড়ে ১২টার দিকে মহারাজপুর ইউনিয়নের শিমলারআইট খেজুরডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারের পরিদর্শনে যেয়ে দেখা যায় সেটি বন্ধ রয়েছে। সেখানের নলকূপটিও নষ্ট। সেখানে উপস্থিত নূরুল ইসলাম বলেন, চরম আতঙ্কের মধ্যে আছি। সত্যি সত্যি যদি ঘূর্ণিঝড় হয় আর বাঁধ ভেঙে যায় তবে পুরো এলাকা লবণপানিতে তলিয়ে যাবে। গেল বছরও সব ভেসে গিয়েছিল। তারাও আরও বলেন, এখানে সুপেয় পানির প্রচুর সমস্যা। আর ফুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইক্লোন শেল্টার খোলা থাকলেও বাথরুমে তালা দেয়া পাওয়া যায়। কেয়ারটেকার বলেন, আশপাশের লোকে নষ্ট করে, এজন্য তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। প্রয়োজন হলে খুলে দেয়া হবে। বেলা ২টার দিকে মদিনাবাদ লঞ্চঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে ৮/১০ টি পরিবার বসবাস করছে। কথা হয় ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা জরিনার সাথে। তিনি জানান, ৩০ বছর যাবৎ সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। ভয় হয় তবুও যাওয়ার জায়গা নেই। ঝড়ের খবর আসলে রাতে ঘুম হয়না। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি হলে রাস্তার ওপর থাকেন, পানি নেমে গেলে আবার ঘরে ফিরে আসেন। সাইক্লোন দূরে থাকায় বাড়ি ফেলে রেখে সেখানে যাননা। তিনি আরও জানান, তার কোন ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে রেখে স্বামী মারা যায়। সেখান থেকে নদীতে জাল ধরাসহ নানা কাজ করে মেয়েকে বড় করেছেন। এখন মেয়ে-জামায়ের সংসারে থাকেন। ৬ সদস্যের পরিবার। মেয়ে নদীতে জাল টেনে পোনা সংগ্রহ করে ও জামাই নৌকা তৈরির কারিগর। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, কয়রা উপজেলায় পাউবোর ১৫৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে এ সব বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারে। কয়রা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ হাসানুল বান্না জানান, সোমবার ভোর থেকে কয়রায় ৩০/৩৫ কিলোমিটার বেগে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। মূল আঘাতের সময় বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পেয়ে ৯০/ ১০০ কিলোমিটার হতে পারে। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় রিপোর্ট প্রদানে সমস্যা হচ্ছে। খুলনার কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, কয়রার হরিণখোলা ও গাতিরঘেরীর বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। স্থানীয়রা কিছুটা মেরামত করলেও ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া উপজেলার ব্গালী ইউনিয়নের হোগলা, মহারাজপুর ইউনিয়নের পবনা, দোশহালিয়া, কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট, ঘাটাখালী, অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ।জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বাড়লে এ সব বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করতে পারে। প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে স্ব স্ব এলাকার বাঁধের দিকে খেয়াল রাখার জন্য। সাইক্লোন শেল্টারগুলো প্রস্তুত রাখাসহ ১২টি মেডিকেল টিম গঠন, উদ্ধার টিম, শুকনো খাদ্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মানুষকে সতর্ক করতে মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রোকুনুজ্জামান বলেন, উপজেলা প্রশাসন ও সিপিপিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে সতর্কতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কয়রা উপজেলাজুড়ে ১১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রসহ বিভিন্ন বিদ্যালয় ভবন, পাকা ও নিরাপদ স্থাপনা প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়ের জন্য। নিরাপদ পানি ও খাদ্য মজুত করা হয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। জেলা ত্রাণ ও পূনর্বাসন অধিদপ্তর থেকে কয়রা উপজেলায় ১০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ২ লাখ টাকা, ৪০০ প্যাকেট শুকনো খাবারের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গেল বছর ইয়াসের খুলনার কয়রায় নদীর বাঁধের ১১ স্থান ভেঙে প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাতিরঘেরী এবং দশহালিয়া এলাকা ৩ মাসেরও বেশি সময় পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ২০২০ সালের ২০ মে সুপার সাইক্লোন আম্ফানের আঘাতে বেশ কয়েকটি স্থানের বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় উপজেলার অধিকাংশ স্থান ডুবে যায়, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বসতবাড়ি।