সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত জনগোষ্ঠিকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে রংপুরের তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া সম্প্রদায়ের টেকসই কর্মমূখী জীবনমান উন্নয়নে সরকারী-বেসরকারী কার্যকর সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে পিছিয়ে পড়া এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোত ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধের চেতনা নিয়ে সমাজের বিত্তবান শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবকদের টেকসই কর্মসূচী নিয়ে স্থায়ী কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর এ লক্ষ্যে রংপুরে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করে তা কিছুটা পরিপালন করছে। তবে এ ব্যাপারে সমন্বিত উদ্যোগ এবং সুর্নিদিষ্ট স্থায়ী কর্মমূখী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় সে উদ্যোগ কার্যত কোন ইতিবাচক সুফল বয়ে আনতে পারছে না। ফলে কর্মহীন অবহেলিত এই বিরাট হিজড়া জনগোষ্ঠির মধ্যে এদের একটি শ্রেণী সমাজে প্রতিনিয়ত উশৃংখল ও অশালীন আচরন অব্যহত রেখে সামাজিক জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। এরা একদিকে পরিবার ও সমাজে অবজ্ঞা, উপেক্ষা, উপহাস এবং কৌতুকের পাত্র হয়ে যৌন প্রতিবন্ধী এই জনগোষ্ঠির মানুষগুলো সমাজ সভ্যতার নাগপাশ থেকে ছিটকে পড়ে অবহেলিত জীবন যাপন করছে। অপরদিকে তারা সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে যেন উপহাস আর বিনোদোনের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রকাশ, পিছিয়ে পড়া তৃতীয় লিঙ্গের এই হিজড়া স¤প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে সমাজসেবা অধিদপ্তর ইতোমধ্যে রংপুর জেলার ৮ উপজেলায় জরীপ চালিয়ে ৩৭০ জন হিজড়াকে তালিকাভুক্ত করেছে। এসব তালিকা ভুক্তদের মধ্য থেকে রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকাসহ ৭ উপজেলার মোট ১৫০ জন হিজড়াকে বাছই করে তাদের আত্মকর্ম সংস্থানের উদ্যেশ্যে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করে। তবে এরপর থেকে এই প্রশিক্ষন কার্যক্রম অজ্ঞাত কারনে বন্ধ রয়েছে।
এই কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে তাদের সেলাই, কম্পিউটার, বিউটিফিকেশন এবং রান্না সহ হাতের কাজের কারিগরী প্রশিক্ষনের ব্যাবস্থা করা হয়। তিন মাস মেয়াদী এই প্রশিক্ষন শেষে এদের প্রত্যেকে আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ১০ হাজার টাকা করে এককালীন আর্থিক সহায়তাও দেয়া হয়। এই কর্মসূচীর আওতায় ইতোমধ্যে ১৫/২০ জন তৃতীয় লিঙ্গের হিজড়া স্বাবলম্বী হয়েছে বলে তাদের সূত্রে জানা গেছে। তবে এদের অধিকাংশই এখন রয়েছে কর্মহীন। ফলে ভিক্ষাবৃত্তি এবং চাঁদাবাজীই এই জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার স্বম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অবহেলিত ও অনগ্রসর জন গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত এই হিজড়া সম্প্রদায় আবহমান কাল ধরে পারিবরিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং সামাজিক নিরাপত্তা সহ বিভিন্ন ভাবে চরম বৈষম্যমূলক আচরনের শিকার হয়ে আসছেন। পাশাপাশি এদের একটি অংশ সমাজের প্রত্যাহিক জীবন ধারায় অসামাজিক ও অশ্লীল আচরনের মাধ্যমে মানুষকে অস্বস্থিকর পরিবেশে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এরা দল বেঁধে বিভিন্ন সড়কের গুরুত্বর্পূন এলাকায়, বাসা বাড়ী, যানবাহন, যাত্রীবাহী বাস ও ট্রেন এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চাঁদাবাজী এবং ভিক্ষাবৃত্তি করে জন জীবনকে চরম বিব্রত করে তুলছে। শুধু তাই নয় স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী বিশেষ করে ছাত্রী এবং নারী যাত্রী ও পথচারীদের সহ নিরিহ পথচারীদের সাথে এরা নানা ধরনের অশ্লীল আচরন এবং অঙ্গী-ভঙ্গী করে তাঁদের চরম অস্বস্থিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে জোরর্পূবক চাঁদা আদায় করছে। বিশেষ করে বিভিন্ন ঈদ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই প্রবনতা আরও বেড়ে যায়।এসব অস্বস্থিকর অসামাজিক পরিবেশ প্রতিরোধে সমাজসেবা অধিদপ্তর, জেলা এবং পুলিশ প্রশাসন সহ সবাই যেন র্নিবিকার নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করে আসছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, রংপুর মহানগরীর প্রবেশ দ্বার মর্ডান মোড়, মেডিকল কলেজ হাসপাতাল মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়, মাহিগঞ্জ সাত মাথা মোড়, নববাগঞ্জ বাজার ও সিটি বাজার এলাকা এবং কাচারী বাজার এলাকা সহ মহানগরী এবং জেলা-উপজেলার বিভিন্ন জনঅধ্যুষিত স্থানে এই হিজড়া সম্প্রদায়ের একটি অংশ দল বেঁধে এ ধরনের চাঁদাবাজি এবং অসামাজিক কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে আসছে। এসব দেখা কিংবা প্রতিরোধ করার যেন কেউ নেই। সম্প্রতি নগরীর কামাড়পাড়া এলাকায় এক বাসায় প্রবেশ করে এই হিজড়ার দল শিরিন বেগম নামে এক গৃহবধূকে তাঁর শিশু সন্তান সহ জিম্মী করে ১০ হাজার টাকা দাবী করে। শেষে কিছু টাকা দিয়ে পরিবারটি ঐ যাত্রায় রক্ষা পায়। এ চিত্র প্রায় সর্বত্র বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে রংপুর জেলা সমাজসেবা অধিপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল মতিন এই প্রতিবেদককে জানান, রংপুর নগরীর বিভিন্ন স্থানে উত্যাক্ত করা হিজরা জনগোষ্ঠিরা ভিন্ন এলাকা থেকে আগত এবং বহিরাগত। এরা রংপুর জেলার বাসিন্দা নয়। তিনি জানান, হিজরা জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এদের কাউন্সিলিং করে এসব বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে রংপুর জেলা হিজরা নেতা আনোয়ারুল ইসলাম রানা জানালো ভিন্ন কথা। তাঁর ভাষায় এরা রংপুরেরই সন্তান। তবে পেটের ক্ষুধা নিবারনের জন্য এসব করে থাকে। আমরা এসব আচরন না করার জন্য পরামর্শ দেই। তবে জীবন পরিচালনার কাজ পেলে এসব বন্ধ হবে বলে তাঁর বিশ্বাষ।
পিছিয়ে পড়া অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোত ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সমাজসেবা অধিদপ্তর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর আওতায় তালিকাভুক্ত হিজড়াদের মধ্য থেকে বাছাই করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারিগরী প্রশিক্ষন দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার উদ্দ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সহায়তা ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। এরমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি ৭’শ টাকা, মাধ্যমিক শিক্ষার্থী ৮’শ টাকা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী ১১’শ টাকা এবং উচ্চতর শিক্ষার্থীদের ১২’শ টাকা হারে প্রতিমাসে উপবৃত্তি দেয়া হয়। এই কর্মসূচীর আওতায় রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৬ জন এবং মিঠাপুকুর উপজেলায় ৩ জন হিজড়া শিক্ষার্থী শিক্ষা সহায়তা ভাতা পাচ্ছে। এছাড়া ৫০ বছর বা তর্দূধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ বয়স্ক ভাতা কর্মসূচীর আওতায় জনপ্রতি মাসে ৬’শ টাকা হারে রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২ জন, পীরগঞ্জ উপজেলায় ১১ জন, মিঠাপুকুর উপজেলায় ১০ জন ও বদরগঞ্জ উপজেলায় ১ জন সহ রংপুর মহানগর এবং জেলায় মোট ৩৩ জন হিজড়াকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর আওতায় মাসিক ভাতা দেয়া হচ্ছে বলে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে হিজড়াদের সংগঠন ”ন্যায় অধিকার তৃতীয়লিঙ্গ উন্নয়ন সংস্থা”, রংপুরের সভাপতি হিজরা আনোয়ারুল ইসলাম রানা জানালো হৃদয় বিদারক কিছু মর্মর্স্পশী কথা, তাঁর ভাষায়, তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষ গুলো সর্বপ্রথম নিজ গৃহ থেকেই নিগৃহীত হন। এরাও যে মানুষ তা বোঝাতে যুদ্ধ করতে হয়। কেবল মা ছাড়া আর কেউ এদের স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেন না। পরিবারের অন্য সদস্যদের কথিত ’পারিবারিক ভবিষ্যৎ নিরাপদ’ পরিবেশের স্বার্থেই তারা যেন এমন বঞ্চনার শিকার।
রংপুরের হিজড়া বাঁধন, জলিল, আরিফ, হারুন, জানু, রাশেদুল, সোণালী, শেফালীরা দূঃখ করে জানালো, আমরা হিজড়া হয়ে জন্মাতে চাইনি। বিধাতার খেয়ালেই আমাদের এ পরিনতি। সমাজের অন্য মানুষের মতই আমরাও সম্মান মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই। হিজড়া যেন আমাদের কাছে একটি অভিশপ্ত বাক্য। পরিবার ও সমাজের অবহেলায় আমাদের অনাহারে-অর্ধহারে র্দূবিসহ জীবন কাটে। ফলে বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে ভিক্ষা করে অতিকষ্টে জীবন ধারন করতে হয়। সরকার এবং সমাজের সচেতন স্বার্মথবান মানুষরা আমাদের স্থায়ী কর্মসংস্থান সহ সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করলে আমরাও সমাজের কল্যানে গুরুত্বর্পুন ভুমিকা পালন করতে পারবো।
ইতোমধ্যে আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ লেখাপড়া শিখে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। স্বেচ্ছাসেী সংগঠনের মাধ্যমে রোগীদের সেবা দিয়ে সমাজের কল্যান মূলক কাজ করে এবং বিভিন্ন পেশা ভিত্তিক কাজে সে সব মানবিক যোগ্যতার প্রমান দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হিজরা জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ে কথা হলো রংপুরের বিশিষ্ট শিল্পপতি ব্যবসায়ী ও রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী টিটুর সাথে।
তিনি বলেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসায় হিজরা সম্প্রদায় আগের থেকে কিছুটা সুশৃংখল। তবে এদের শারীরিক কাঠামো অনুপাতে উপযোগী কর্মসংস্থানের মত পরিবেশ ও সুযোগ এখনও রংপুরে গড়ে ওঠেনি। এদের জন্য গার্মেন্টস শিল্পের মত বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এজন্য সরকারী সহায়তায় সমাজসেবা অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের সবাইকে সরকারী ভাতার আওতায় এনে ভাতার পরিমান জীবন চলার উপযোগী করে বাড়ানো উচিৎ। সেই সাথে সরকারের আবাসন প্রকল্পের মাধ্যমে এদের পূর্নবাসনের ব্যাবস্থা করা প্রয়োজন।
হিজরাদের সামাজিক উশৃংখলতা নিয়ে কথা হলো রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেনের সাথে।
তিনি বলেন, এদের পূর্নবাসন এবং মোটভিশনের বিষয় নিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাথে আমরা বসেছি। সরকারও সাধ্যমত কিছু করছে। হিজড়াদের চাদাঁবাজী বন্ধে বিভিন্ন পয়েন্টে মাঝে মাঝে একশনও নেয়া হয়। কখনওবা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরী হয়। এসব নিয়ন্ত্রনে আমরা কাজ করছি।