বেনাপোল কাস্টমসের ভল্ট থেকে ১৮ দশমিক ৩৮ কেজি স্বর্ণ পরিকল্পিতভাবে চুরি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততায় এই অপকর্ম হয়েছে।
সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে সিআইডি তদন্ত করছে। কিন্তু এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই বা সন্দেহজনক কাউকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দেখা যায়নি।
শুধু তাই নয়, কাস্টমসের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ১০ মাসেও চূড়ান্ত হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নিতে কাস্টম কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
প্রসঙ্গত, গত ১১ নভেম্বর বেনাপোল কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের ভল্ট থেকে ১৮ দশমিক ৩৮ কেজি স্বর্ণ চুরি হয়েছে।
৮-১০ নভেম্বর টানা ৩ দিন সরকারি ছুটির পর ১১ নভেম্বর অফিস খুললে ভল্টের দরজার হেজবোল্ট ও তালা ভাঙা পাওয়া যায়।
ঘটনার পর রাজস্ব কর্মকর্তা এমদাদুল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে বেনাপোল থানায় মামলা দায়ের করে। পাশাপাশি ভল্টের ইনচার্জসহ ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনা স্বর্ণ চুরির বলা হলেও তা আদৌ চুরি ছিল কি না- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। কারণ ভল্ট কাস্টম হাউসের দোতলায় অবস্থিত।
কাস্টম হাউসের অবস্থান বা বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভল্ট পর্যন্ত একক বা দলবদ্ধভাবে যেতে হলে কোনোভাবেই দায়িত্বরত আনসার সদস্যের ফাঁকি দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
আর সবার অগোচরে ভল্টরুমে গিয়ে কাঠের দরজা, লৌহ নির্মিত কাঠামো ও দেয়াল ভেঙে চুরি করা অবিশ্বাস্য। পাশাপাশি ভল্টের দেয়াল যে পরিমাণ ভাঙা ছিল তা দিয়ে মানুষ ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
চুরির ব্যাপারে যে সন্দেহ রয়েছে, সে প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভল্ট রুমে প্রায় ৩০ কেজি স্বর্ণ এবং ১৫ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রাসহ মূল্যবান সরঞ্জামাদি থাকলেও শুধু ১৮ দশমিক ৩৮ কেজি স্বর্ণ চুরি হয়।
এছড়া ভল্ট রুমের সামনের সিসিটিভি ক্যামেরা ঘটনার আগে থেকেই নষ্ট ছিল।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার ১০ মাস পার হলেও কাস্টমসের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
এমনকি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহের পর দফায় দফায় তদন্ত করলেও এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি।
ফলে স্বর্ণ চুরির সঙ্গে জড়িত গডফাদারদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এমনকি দীর্ঘসূত্রতার কারণে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ায় এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, চুরির ঘটনায় বন্দর ব্যবহারকারীদের মনে শুরু থেকেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। ভল্টের পাশেই একজন উপ-কমিশনারের কক্ষ রয়েছে। সিসি ক্যামেরা থাকলেও তা অচল করা হয়।
ক্যামেরা সচল থাকলেও মূল মেশিন থেকে তা বিচ্ছিন্ন ছিল। কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া ভল্টে সিন্দুকের অবস্থান বা এতে প্রবেশের কলাকৌশল, নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে বহিরাগতদের পক্ষে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা সম্ভব নয়।
ভল্টের প্রবেশে করতে কোথায় কী ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, সেগুলো কীভাবে অতিক্রম করতে হবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল দুষ্কৃতকারীদের।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। চুরির ঘটনা সফল করতে দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল, যা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার গোপনীয় প্রতিবেদনেও এসব বিষয় উঠে এসেছে।
ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে ৪টি স্থির চিত্র দেয়া হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ভল্টের হেজবোল্ট ভাঙা হয়েছে। সেখান দিয়েই দুষ্কৃতকারীরা প্রবেশ করেছে। কিন্তু দেয়ালে ছোট ভাঙা ছিল যা দিয়ে মানুষ ঢোকা সম্ভব নয়।
তাছাড়া ভল্টে প্রবেশের লোহার গেটের তালাও ভাঙা পাওয়া যায়। অর্থাৎ সিসিটিভি অকেজো করে তালা ভেঙে ভল্টে প্রবেশ করে দুষ্কৃতকারীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল কাস্টমসের কমিশনার আজিজুর রহমান বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুনরায় তদন্ত কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
কমিটির কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। খুব শিগগিরই তদন্ত প্রতিবেদন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেবে কমিটি। তিনি আরও বলেন, আমি যোগদানের পর ভল্টসহ পুরো কাস্টমসের নিরাপত্তা জোরদার করেছি।
মূল্যবান গোডাউন নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা মনিটরিং করা হচ্ছে। এজন্য কর্মকর্তাদের রোস্টার করা হয়েছে।
তৎকালীন কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরী বলেন, চেনাজানা লোক ছাড়া ভল্টে এভাবে চুরি করা সম্ভব নয়। কারণ বেছে বেছে ভালো মানের স্বর্ণ চুরি করা হয়েছে।
ডলার ও খাদযুক্ত স্বর্ণ নেয়নি। তিনি আরও বলেন, কাস্টমস সন্দেহভাজনদের বারবার তদন্তকারী সংস্থার কাজে সমর্পণ করলেও অজ্ঞাত কারণে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
কেন ছেড়ে দেয়া হয়েছে তার সদুত্তর পাইনি। এ ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে এবং পুলিশের প্রতি সেই আমাদের আস্থা রয়েছে। অতীতের পুলিশ এ ধরনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার উদঘাটন করতে পেরেছে।
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে যশোর সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, করোনার কারণে তদন্তে ব্যাঘাত ঘটেছে।
আমি যোগদানের পর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার তদন্ত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
জানা গেছে, ঘটনার পরপরই বেনাপোল কাস্টমস তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার শহিদুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
তাছাড়া এনবিআরও উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই টিমের প্রধান করা হয় এনবিআরের সদস্য খন্দকার আমিনুর রহমানকে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- সিআইসি যুগ্ম কমিশনার জাকির হোসেন, যশোরের পুলিশ সুপার মইনুল হক, বেনাপোল কাস্টমসের তৎকালীন কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরী ও বেনাপোল কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার ড. নেয়ামুল ইসলাম।
আর কাস্টমসের তদন্ত কমিটির প্রধান শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে প্রধান করে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার রিপোর্ট ঘটনার ১৫-২০ দিন পরেই জমা দিয়েছি। পরে এনবিআর থেকে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।’