করোনাভাইরাসের কারণে গোটা বিশ্বে ব্যবসায় মন্দাভাব। অচলাবস্থা বাণিজ্যে। বিঘ্নিত হয়েছে উৎপাদন। কমেছে রফতানি। এমন অবস্থায় নতুন করে বিনিয়োগে আসছে না শিল্প উদ্যোক্তারা। অনেকে সংকটে টিকে থাকতে বিদ্যমান ব্যবসা সংকুচিত করেছেন। ফলে শিল্পখাতে ঋণ বিতরণে ভাটা পড়েছে। কমেছে আদায়ের পরিমাণও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৭৪ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক থেকে জুনে শিল্পঋণ বিতরণ কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ৯১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকার শিল্পঋণ বিতরণ করে।
এদিকে ঋণ বিতরণের পাশাপাশি আগে বিতরণকৃত শিল্পঋণ আদায় ৩০ শতাংশ কমেছে। জুন প্রান্তিকে ৬৪ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা শিল্পঋণ আদায় হয়েছে। যা গত বছর একই সময় আদায় হয়েছিল ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগের পরিবেশ এখনও সৃষ্টি হয়নি। যার কারণে সাহস করে উদ্যোক্তারা নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নিচ্ছেন না। উল্টো অনেকে ক্ষতি কমাতে ব্যবসার পরিধি কমিয়ে দিচ্ছেন। মূলধনী যন্ত্রপাতি বড় বড় ইন্ডাস্ট্রির পণ্যের কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে। এসব কারণে শিল্পঋণ কমেছে।
তিনি বলেন, যেকোনো উপায়ে বিনিয়োগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। কারণ নতুন প্রতিষ্ঠান না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। সরকার ব্যবসায়িক ক্ষতি মোকাবিলায় শিল্প খাতসহ বিভিন্ন খাতে যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাদের তদারকি বাড়াতে হবে।
করোনাকালে ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের জন্য বিশেষ সুবিধার সময়ও বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না। এ সুবিধা আগে জুন পর্যন্ত ছিল। ফলে একদিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমেছে। পাশাপাশি কমেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের খেলাপি প্রায় ২১ শতাংশ কমে ৪৫ হাজার ৩২৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছরের জুনে যা ছিল ৫৭ হাজার ২০১ কোটি টাকা। তবে মার্চের তুলনায় জুনে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি কমেছে মাত্র ৫০৪ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে জানান, কোভিড-১৯ এর কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল। সুদহার সিঙেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হলেও মহামারির কারণে এ সুযোগ উদ্যোক্তারা কাজে লাগাতে পারেননি। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। রফতানি বাড়ছে। স্থানীয় বাজারে পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। সরকার লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এটি বিতরণ হচ্ছে। আগামীতে সংকট কেটে যাবে; ঋণের চাহিদাও বাড়বে।
সরকারের নির্দেশনায় করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই তহবিল থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবেন। যার সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হবে, বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ সরকার ভর্তুকি হিসাবে দেবে। এ প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তহবিলের জোগান দিতে ২৩ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করে।
এ তহবিল থেকে ওই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৫০ শতাংশ অর্থের জোগান দেয়া হবে। অর্থাৎ কোনো গ্রাহককে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিলে এর মধ্যে ৫০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দেবে এবং বাকি ৫০ কোটি টাকা দেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারে প্যাকেজের ঋণ দ্রুত বিতরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। একের পর এক শর্ত শিথিল করা হচ্ছে। ১২ এপ্রিল জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, প্যাকেজের মেয়াদ হবে তিন বছর। কিন্তু তা সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। পরে অন্য একটি সার্কুলারের মাধ্যমে এর মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। চলতি বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আলোচ্য প্যাকেজের আওতায় বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা নিতে হবে এবং পরিশোধ করতে হবে।