শেয়ারবাজারে কারসাজি এবং অর্থ আত্মসাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার নাম উঠে এসেছে। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, সাবেক কমিশনার শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ এবং বর্তমান নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানের নাম উঠে এসেছে। এ নিয়ে মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, অদৃশ্য শক্তির জোরে তারা আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আইন লঙ্ঘন করে সালমান এফ রহমানকে বন্ডের অনুমোদন দেওয়ায় দ্বিতীয়বার বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসাবে পুনঃনিয়োগ পান শিবলী রুবাইয়াত।
প্রতিবেদনে বিএসইসির পরিচালক শেখ মাহবুব-উর-রহমান, সরকারি সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আবুল খায়ের হিরু, তার প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভ, হিরুর বাবা আবুল কালাম মাদবর, আলোচিত কারসাজিকারক আব্দুল কাইয়ুম, হিরুর প্রতিষ্ঠান মোনার্ক হোল্ডিংস, ক্রিকেটার ও সাবেক সংসদ-সদস্য সাকিব আল হাসান, বহু বিতর্কিত ও যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকা নিষিদ্ধ ব্যবসায়ী জাবেদ এ মতিন এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট সায়েদুর রহমানের নাম উঠে এসেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করে তারা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সেরা ১০টি প্রতিবেদনের রেফারেন্স উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে প্রতিবেদনের ব্যাপারে সহায়তা করেছেন। তবে এ ব্যাপারে সিআইডির কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আর সালমান এফ রহমান কারাগারে এবং শিবলী রুবাইয়াত পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়াও সম্ভব হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট বিদেশে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দেশেই পালিয়ে ছিলেন তার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। মঙ্গলবার তিনি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ থেকে কোস্টগার্ডের হাতে গ্রেফতার হন। নিউমার্কেট থানায় পুলিশের করা মামলায় বুধবার তাকে ১০ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। এরপরই তার নামটি ব্যাপক আলোচনায় আসে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাজারে বেক্সিমকো গ্রীন সুকুক বন্ড ছেড়ে সালমান এফ রহমান ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নেন। এক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ১০০ টাকা দরে ওই বন্ড কিনতে বাধ্য করা হয়। এছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারের দাম ১০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন সালমান। এতে সহায়তা করেন বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
এছাড়াও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সম্মতি না দিলেও বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম ও তার চক্রটি অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে শেয়ার মার্কেটে দুর্বল কোম্পানি সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, এস আলমের মালিকানাধীন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, শিকদার ইস্যুরেন্স, ক্যাপিটেপ গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড, এশিয়াটিক ল্যাব, বেস্ট হোল্ডিংসসহ বিভিন্ন দুর্বল কোম্পানির আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) অনুমোদন দেয়। এ প্রক্রিয়ায় বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে সহায়তা করেন শিবলী। এর ফলে মার্কেটে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়ে ধারাবাহিক পতন হয়।
শেয়ার মার্কেটে দুর্বল আইপিও অনুমোদন দিলে বিপুল অঙ্কের টাকা মার্কেট থেকে চলে যায়। এরপর সেকেন্ডারি মার্কেটে কারসাজি চক্রের তা-বে ধারাবাহিক পতন হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যান। এছাড়াও বেক্সিমকো লিমিটেডকে ২ হাজার ৬শ কোটি টাকার জিরো কুপন বন্ড অনুমোদন দেন শিবলী রুবাইয়াত। এরপর বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসাবে শিবলী রুবাইয়াতের পুনঃনিয়োগে সরাসরি সহায়তা করেন সালমান এফ রহমান।
এছাড়া শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ, নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান এবং আবুল খায়ের হিরু মিলে বন্ধ থাকা কোম্পানি চালুর উদ্যোগ নেন। এরা অবৈধভাবে সুবিধা নিয়ে বন্ধ কোম্পানি চালু করার নামে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নিজস্ব লোকদের নতুন পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়ে বেশকিছু কোম্পানি দখল করেন। এরমধ্যে এমারেল্ড অয়েলের পর্ষদ ভেঙে মিনোরি বাংলাদেশকে মালিকানা দিয়ে শেয়ার কারসাজি করে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী ২০২২ সালে ঘোষণা দেন ডিএসইর সূচক ১০ হাজার পয়েন্টে উন্নীত হবে। প্রতিদিন লেনদেন ৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কেট ভালো না হলে ফ্লোর প্রাইস (নিুসীমা) তুলবেন না। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তার কথা বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু ধারাবাহিক পতনের মধ্যে বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস তুলে দেয়। এ সময়ে সূচক ৫ হাজার ২শ পয়েন্টে নেমে আসে। লেনদেন নেমে আসে মাত্র ৩শ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। এতে শিবলী রুবাইয়াত, শেখ শামসুদ্দীন আহমেদ এবং আবুল খায়ের হিরু লাভবান হয়েছেন। আর ভুয়া তথ্যের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করেছেন।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, শেখ শামসুদ্দীন আহমেদের সহায়তায় বিএসইসি পরিচালক শেখ মাহবুব উর রহমান নিজ রুমে সার্ভেইল্যান্স সফটওয়্যার (নজরদারি সফটওয়্যার) অবৈধভাবে সংযোগ স্থাপন করে কারসাজি চক্রকে শেয়ার বাজারের অতি সংবেদনশীল গোপন তথ্য দিয়ে আসছিল। এই প্রক্রিয়ায় চক্রটি মিলে কোটি কোটি আত্মসাৎ করেছেন। বাজারে ধারাবাহিক পতনের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
অন্যদিকে পুঁজিবাজারে কারসাজির ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম মো. আবুল খায়ের হিরু। সেই হিরু সিন্ডিকেট ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংক, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রকৌশল খাতের বিভিন্ন শেয়ারের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে কারসাজির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে ডিএসই থেকে কারসাজির তথ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিতে পাঠানো হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে শিবলী রুবাইয়াত, শামসুদ্দীন, সাইফুর রহমান এবং শেখ মাহবুব-উর রহমানের সহযোগিতায় আবুল খায়ের হিরু, আব্দুল কাইয়ূম, জাবেদ মতিন এবং সায়েদুর রহমানসহ কারসাজি চক্র শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে দীর্ঘদিন কারসাজির পর নামমাত্র টাকা জরিমানা করে বিপুল টাকার বৈধতা দিয়েছেন রুবাইয়াত-উল-ইসলাম।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ৪ বছরে বিএসইসিতে ১৮৪টি তদন্ত রিপোর্ট পাঠিয়েছে ডিএসই। কিন্তু আবুল খায়ের হিরুকে কয়েকটি কারসাজির মাধ্যমে নাম মাত্র জরিমানা করে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম অবৈধভাবে বিপুল অঙ্কর আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। এছাড়াও অনৈতিকভাবে বিপুল সুবিধা নিয়ে একক সিদ্ধান্তে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজের ৩শ কোটি টাকার রূপান্তরযোগ্য বন্ড অনুমোদন দেন শিবলী। যা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ইতিহাসে বিরল।
শিবলী রুবাইয়াত বিএসইসিতে যোগদানের পর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জের অনেক ক্ষমতা খর্ব করে বাজারে একক আধিপত্য বিস্তার করে। এর ফলে ডিএসই থেকে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে আইপিও অনুমোদন না দিতে সুপারিশ করলেও তিনি তা আমলে নেননি। রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সিন্ডিকেট বিপুল অঙ্কর টাকা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে একক ক্ষমতাবলে দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়ে মার্কেট হতে হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছেন।