কুয়াশা আর ভোরে লতা-পাতা ও ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু জমে থাকাই জানান দিচ্ছে গ্রামীণ জনপদে শীতের আগমনী বার্তা। শীত মৌসুমকে কেন্দ্র করে বগুড়া জেলার বিভিন্ন গ্রামে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। আজ ২৯ অক্টোবর সরেজমিন দেখা যায়, বগুড়া জেলার ১২টা উপজেলায় বিভিন্ন গ্রামের গাছিরা শীতের আমেজ শুরুর সাথে সাথে আগাম রস পাওয়ার আশায় কিছু গাছি গাছের পরিচর্যা শুরু করছে। শীতের মৌসুম শুরু হতে না হতেই খেজুরের রস আহরণের জন্য গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করছে। হাতে দা ও হাঁসুয়া নিয়ে,কোমরে ডোঙা বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাচা ছেলা করছেন গাছিরা। আগে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামের মাঠে মাঠে ফসলি জমিতে কিংবা রাস্তার পাশে, বাড়ির পাশে জমির আইলে সারি সারি খেজুর গাছ বেশি দেখা গেলেও এখন আর সেই রকম বেশি খেজুর গাছ চোখে পড়ে না। বগুড়া জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার বিজরুল,লোকপাল গ্রামের, কাহালু উপজেলার মালঞ্চা গ্রামের, শাজাহানপুর উপজেলার জামাদার পুকুর, টেংরা মাগুর গ্রামের গাছিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কার্তিক মাস থেকে রসের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুত করা শুরু হয়। শীত যত বেশি হয়, গাছ থেকে তত রস বেশি পাওয়া যায়। অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ এই তিন মাস খেজুর রস সংগ্রহ করা হয় । গাছি প্রতিদিন বিকালে ছোট-বড় কলসি মাটির পাত্র গাছে বাঁধা হয়, আর সকালে রস সংগ্রহ করা হয়। কেউ কেউ কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করেন। সপ্তাহের চার দিন রস সংগ্রহ করা যায়। এর ফলে গাছের রস বেশি পড়ে। গাছ একবার ছাঁটলে ৩-৪ দিন রস সংগ্রহ করা হয় এবং পরবর্তীতে ৩ দিন শুকাতে হয়। এইভাবে কাটলে গাছের রস সুমিষ্ট হয়। রস সাধারণত অগ্রহায়ণ হতে মাঘ মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করতে হয়। রস সংগ্রহের পর হাড়ি পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকাতে হয় অথবা আগুনে ছেকে নিতে হয়। গ্রামীণ জনপদের আসন্ন নবান্ন উৎসবের অপরিহার্য উপাদান খেজুরের রস আর গুড়। শীতের সকালে নানাভাবে খাওয়া হয় এ রস। শীত কিছুটা বাড়লেই শুরু হয় রস সংগ্রহ, রস থেকে তৈরি হয় গুড় ও পাটালি। যার স্বাদ ও ঘ্রাণ মানুষকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া খেজুরের রসের তৈরি পিঠা-পুলি আর পায়েস যেন শীতকে করে তোলে আরো পরিপূর্ণ। কিছুদিনের মধ্যে আমন ধান ঘরে তোলার পালা ফলে নতুন ধানের পিঠা, পুলি ও পায়েশ তৈরির ধুম পড়ে যাবে গ্রামে গ্রামে। তাছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ও মুড়ি খাওয়ার জন্য কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে শীতের মৌসুমে এ রস দিয়ে হরেক রকম খাবার অতি প্রিয় হয়ে ওঠে । নন্দীগ্রাম উপজেলার লোকপাল গ্রামের মো: হাসান আলী বেশ কয়েক বছর ধরে খেজুর গাছ ঝুড়ার কাজ করে,প্রতি বছর দুই থেকে তিন হাজার খেজুরের গাছ ঝুড়ার কাজ করে থাকে , প্রতি খেজুরের গাছের জন্য নিয়ে থাকেন ৮০ থেকে ১০০ টাকা, এবার চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ১,২০০টি খেজুর গাছ ঝুড়ার কাজ করেছে, আগামী মাস পর্যন্ত গড় ২৫০০ খেজুর গাছ ঝুড়ার কাজ করবে বলে আশাবাদী । তিনি এই কাজ করে প্রতিবছর দেড় লাখ থেকে ২লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে। শাজাহানপুর উপজেলার সাহেব আলী মাত্র ১৬ বছর বয়স থেকেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করেন।১৪০টি খেজুর গাছ মালিকদের কাছে থেকে প্রতি গাছের জন্য তিন কেজি গুড় দিবে বলে বর্গা নেন । তিনি ৬৩ বছর জীবনে খেজুর গাছের রসের টান এখন পর্যন্ত ঝুঁকি নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতি বছর গুড় থেকে এক লাখ টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে। কাহালু উপজেলার মালঞ্চা গ্রামের গাছি শাহ আলম, প্রতিবছর ৮০ থেকে ১০০ টা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে এবার ৮০টা খেজুর গাছ মালিকদের কাছে থেকে প্রতি গাছের জন্য ৩ কেজি গুড় দিবে বলে বর্গা নেন। রস সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন গ্রামে হাতে দা ও হাঁসুয়া নিয়ে, কোমরে ডোঙা বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাছাছোলা পরিচর্যা করছে। তিনি প্রতি বছর গুড় থেকে ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে। নন্দীগ্রাম উপজেলার বিজরুল গ্রামের গাছি আব্দুল আলিম প্রতিবছর ৭০ থেকে ৮০ টা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে। এবার ৭৫ টা খেজুর গাছ মালিকদের কাছে থেকে প্রতি গাছ ২ কেজি গুড় দিবে বলে বর্গা নিয়েছেন। কার্তিক মাসের শুরু থেকেই তিনি আগাম রস পাওয়ার জন্য গাছ প্রস্তুত করছে। তিনি প্রতিবছর গুড় থেকে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় করে থাকে। বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক কৃষিবিদ মো. ফরিদুর রহমান, আগের চেয়ে খেজুর গাছের সংখ্যা এখন অনেকটাই কমে গেছে তারপরেও এখনো অনেক এলাকায় খেজুর গাছ রয়েছে, ইতিমধ্যে শীতের আগমনী বার্তায় গাছিরা খেজুর গাছ পরিচর্যা করছে, এই খেজুর গাছ ফসলের কোনো ক্ষতি করে না। আমাদের উচিত এই গাছ একটা করে হলেও রোপণ করার। এই গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ করতে হয় না। গাছ রোপন করলেই যা সকলের রস ও গুড়ের চাহিদা মেটাবে। বগুড়া জেলার অনেক উপজেলার ইউনিয়নে আগাম খেজুর গাছ ঝুড়া শুরু হয়েছে। সেখান থেকে কৃষকরা খেজুরের রস সংগ্রহ করবে এবং তা থেকে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি পণ্য তৈরি করবে এবং যা নিকটস্থ বাজারে বিক্রি করে তারা ব্যাপকভাবে লাভবান হবেন ।