বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিপদের আশঙ্কা ব্যক্ত করে যে কোনো বিপদ মোকাবিলায় সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়েছেন। তিনি আজ বুধবার দুপুরে পীরগঞ্জের বাবনপুরে শহীদ আবু সাইদের কবর জিয়ারতের পর বিকেলে স্থানীয় জাফরপাড়া দারুল উলুম মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত এক সম্প্রীতি সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ আহবান জানান।
রংপুর জেলা বিএনপির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এখনও আমাদের বিপদ যায়নি, সেই বিপদকে মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যের মধ্যদিয়ে দেশের সকল স্তরে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক জঞ্জাল পরিস্কার করে নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ অন্তর্বতী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই, সেই নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আপনারা একটা অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি করবেন’।
বিএনপি মহাসচিব উল্লেখ করেন, ‘সারা বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ শহীদ হয়েছে, তাদের শাহাদৎ বরণ অর্থাৎ আত্মত্যাগকে অর্থবহ করবার জন্য আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের অশুভ ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে হবে। রাজধানীসহ প্রান্তিক পর্যায়ে নাগরিক কমিটি গঠন করতে হবে। দেশব্যাপি গঠিতব্য এসব কমিটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করবেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক সম্পীতির বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আমরা সবাই এক সাথে বাস করি। কেউ যেন বিদ্যমান এ সম্প্রীতিতে চিড় ধরানোর সুযোগ নিতে না পারে, সেজন্য সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।’
সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সর্বদা আন্তরিক এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবসময়ই আপোষহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আপনাদের কাছে আহবান জানিয়েছেন, ‘প্রতিহিংসা নয়, প্রতিশোধ নয়, আমরা ভালবেসে প্রেম দিয়ে সমস্ত মানুষকে একত্রিত করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। ছাত্র-জনতার ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে হবে। পরাজিত শক্তি যেন ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য আন্দোলনকারী প্রতিটি দলকে সজাগ থাকতে হবে, ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। পরাজিতদের নির্মূল করতে হবে। আমরা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করবো।’
জেলা বিএনপির আহবায়ক সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ ও রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলু বক্তৃতা করেন।
বিএনপি মহাসচিব পীরগঞ্জবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘পীরগঞ্জ এখন ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, আপনাদের ছেলে, আপনাদের সন্তান আবু সাঈদ তাঁর বুকের রক্ত দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন ইতিহাস শুরু করে দিয়েছে। সেই ইতিহাস হচ্ছে তরুণদের আত্মত্যাগের ইতিহাস, নতুন স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করবার ইতিহাস। রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র আবু সাঈদ প্রাণ দিয়েছে, বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদি খুনি সরকারের পদত্যাগের দাবীতে। স্বৈরাচার সরকারের পতনের দাবীতে সারা বাংলাদেশে শত শত ছাত্র-জনতা তাদের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে, কিন্তু এখনও পুরোপুরি স্বাধীন হয়নি। আপনারা জানেন জনগণের চাপের মুখে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর আন্তরিক হস্তক্ষেপের ফলে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। তবে ভারতে পালিয়ে গিয়েও শেখ হাসিনা চুপ করে বসে নেই। ভারত থেকে আবারও ষড়যন্ত্র করছে, চক্রান্ত করছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন হচ্ছে এগুলো বলে আন্তর্জাতিক বিশ^কে বিভ্রান্ত করবার জন্য নতুন চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সেজন্য আমরা সম্প্রীতি সমাবেশ করছি। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এক সাথে আমরা যে নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই স্বাধীনতাকে সুসংহত করবার জন্য আমরা এই সম্প্রীতি সমাবেশ করছি।’
মির্জা ফকরুল বলেন, শেখ হাসিনার সরকার জবরদস্তিভাবে ক্ষমতায় থাকতে শত শত মানুষকে খুন করেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। নষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে তিনি পরিবারতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। ভেবেছিল কোনদিন তাকে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হবে না, খুব বড় বড় গলায় বলতো আমি কোনদিন পালাবো না, আমি শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, আমি পালাই না। কথা রাখতে পারেননি, গণঅভূত্থানে একেবারে লেজ গুটিয়ে আধাঘন্টার মধ্য হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ওই ভদ্রলোক কোথায় ? যিনি বার বার বলতেন পালাবো না, ফখরুলের বাড়িতে গিয়ে উঠবো, কোথায় উঠেছে এখন কেউ জানে না, আমি তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, আসেন আমার বাসায় আসেন।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ এখন জেগে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে, যারা হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, শত শত মিথ্যা মামলা দিয়েছে, এখানে উপস্থিত একজন মানুষও নাই যার বিরুদ্ধে মামলা নাই। এই ভয়াবহ জালিম হত্যাকারী খুনি সরকারের পতন হলেও তাদের প্রেতাত্মারা এখনও বাংলাদেশে আছেন। আমরা বলেছি, সব পুলিশ খারাপ না, যে সমস্ত পুলিশ কর্মকর্তারা এই হত্যাকান্ড চালিয়েছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে তাদের বিচার করতে হবে। হাসিনার বিচার করতে হবে, তাঁর মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়া মন্ত্রীদেও মধ্যে যারা চুরি করেছে, ডাকাতি করেছে, হত্যা করেছে, তাদের সকলের বিচার করতে হবে। বিচার শুরু হয়েছে, আল্লাহর মার দুনিযার বাইর, মহান আল্লাহই করে দিয়েছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। আজকে সেজন্য তারা পালিয়েছে এবং আপনারা জেগে উঠেছেন।’
বিএনপি মহাসচিব এই সভায় জানান, ‘সাঈদের বাবা বোকা হয়ে গেছেন, মা কথা বলতে পারেন না, তাদের একমাত্র সন্তান, তাদের আশা ছিল এই সন্তান তাদের দু:খ ঘোচাবে। ইংরেজিতে অর্নাস পড়–য় সাঈদ টিউশনি করে পড়তো, অত্যন্ত মেধাবী ছেলে তাকে কিভাবে একটা দেশের পুলিশ সরাসরি বুকে গুলি করে মারতে পারে। কি সাহসি ছেলে আবু সাঈদ, দু-হাত মেলে ধরে দাঁড়িয়েছিল, একটা গুলি খেয়ে দমেনি, আবারও গুলি খেয়েছে।’
এর আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুপুর ১ টা ৪০ মিনিটে পীরগঞ্জের বাবনপুরে এসে পৌঁছার পরপরই আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করেন। এরপর তিনি আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হন।
তিনি এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশে যে দুর্নীতি ও দুঃশাসন সৃষ্টি করেছিল তারই ফলশ্রুতিতে তাদের পতন হয়েছে। আবু সাঈদের মতো ছাত্রসহ অনেকেরই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মত স্বাধীন হল। দেশের স্বৈরাচার হঠাতে আত্মত্যাগকারী এসব শহীদের ত্যাগ কোন দিনই ভোলার নয়। তাই আমাদের দায়িত্ব হল, ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে, স্বাধীন রাষ্টে গণতন্ত্র পূনপ্রতিষ্ঠা করা’। তিনি বলেন, ‘জনগনকে আমি আহবান জানাবো – কোন চক্রান্তে পা দিবেন না, আপনারা চক্রান্ত রুখে দিয়ে এই অন্তর্বতীকালিন সরকারকে সহযোগিতা করুন। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচনের দিকে ধাবিত করতে সহায়তা করুন।
উল্লেখ্য, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।