ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের প্রথম বৈঠকে গুরুত্ব পেয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল করা প্রসঙ্গ। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বৈষম্যহীন নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ নিয়ে দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করতে সরকারের সঙ্গে ‘সহকারী উপদেষ্টা’ হিসেবে কাজ করবে শিক্ষার্থীরা। বৈঠকে কিভাবে শিক্ষার্থীদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা হবে, তার কাঠামো কি হবে তা নিয়ে কথা হয়। ছাত্রদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তদারকির সুযোগ করে দেওয়া হবে।
এছাড়া বৈঠকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত খুলে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনে চলা প্রত্যেক গুলির স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিচারের ব্যবস্থা করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়।
শুক্রবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাকি উপদেষ্টারা ছাড়াও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বৈঠকে তিন বাহিনী প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা অংশ নেন।
পরে বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য তারা (শিক্ষার্থীরা) আন্দোলন করেছেন। সুতরাং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আজকে আমাদের বেশিরভাগ আলোচনা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা এবং দেশের অর্থনীতি সচল কিভাবে করা যায় সে প্রসঙ্গে।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতির বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে এ উপদেষ্টা বলেন, বৈঠকে আইজিপিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তার কাছে কী তথ্য আছে? তাছাড়া পুলিশের অনেকগুলো থানাও সচল নয়। ফলে তার কাছে সব তথ্য থাকবে সেটাও আমরা মনে করি না। তাই আলোচনা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে নামানো, বিশেষ করে পুলিশ সদস্যদের।
অর্থের ব্যাপারে বৈঠকে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আর্থিক খাতগুলোকে শুধু চালু করলেই হবে না। সক্রিয় করতে হবে এবং সেখানে নেতৃস্থানে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন যেগুলো আছে, অনতিবিলম্বে সেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ব্যবসাকে উজ্জীবিত করার জন্য যত ধরনের সুরক্ষা নেওয়া যায়, সেটা আমাদের আইডেন্টিফাই করে, সেই সুরক্ষাগুলো আমাদের নিতে হবে। যাতে ব্যবসায়ীরা যারা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন, তাদেরকে আবারও উজ্জীবিত করা যায়। জনগণের জীবন এবং জীবিকার কষ্ট লাঘব করতে বাজারের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ, অর্থের ক্ষেত্রে যে নিয়ন্ত্রণ, সেটা অগ্রাধিকার পাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনার ক্ষেত্রে। মোটামুটি আজকের বৈঠকে এসব আলোচনা হয়েছে। বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনার জন্য একটু সময় তো লাগবে।
যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, এখনো রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই, শিক্ষার্থীরা রাস্তা ম্যানেজমেন্ট করছেন। সেই প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি না যে, কালই (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) খুলে দেবো। শিক্ষক সমাজের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া চেষ্টা করা হবে।
সরকারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা যারা দায়িত্ব নিয়েছি আমাদের সব মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সম্পৃক্ত থাকবেন। কিভাবে তারা সম্পৃক্ত থাকবেন, এটার কাঠামো কী হবে, এটা আমরা পরবর্তীতে চিন্তা করবো।
সরকারের মেয়াদের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে, তা নিয়ে এখনই আলোচনা করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আপনি কি সংস্কার চান? সেটা না বুঝে মেয়াদের কথা বলতে পারব না। আর আপনারা যদি সংস্কার না চান, তখন আরেক কথা। কাজেই এখনই মেয়াদ-মেয়াদ করে অস্থির হওয়ার কিছু নেই। সংস্কারের জন্য যতটুকু সময় নেওয়া দরকার, ততটুকুই নেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের গণতন্ত্রেই যেতে হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রিজওয়ানা বলেন, প্রত্যেকটা গুলির স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিচার হবে। এমন ঘটনার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেজন্য কোন প্রক্রিয়ায় বিচার করা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতা একটা গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে পড়লে অসুবিধা হয় না। কিন্তু সরকার অগণতান্ত্রিক হলে তখন আইনের অপপ্রয়োগ হয়। তাই সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে বিধানগুলো অপপ্রয়োগ করা যাচ্ছে, সেগুলো চিহ্নিত করে বাতিল করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে ডেকে যমুনায় একদিন বসবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আহতদের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
হয়রানিমূলক মামলাগুলো কিভাবে বন্ধ করা যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এই উপদেষ্টা।
এদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে ‘সহকারী উপদেষ্টা’ হিসেবে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কাজের সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও নতুন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া নাহিদ ইসলাম। বিকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ছাত্র সমাজ আমাদের দেশের একটি বড় শক্তি। নতুন সরকারের সঙ্গে আমরা তাদেরও কাজের সুযোগ দিতে চাই। এ লক্ষ্যে উপদেষ্টাদের সঙ্গে ‘সহকারী উপদেষ্টা’ পদ সৃষ্টি করে শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ তৈরি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাদের যে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা ছিল, বড় বড় দলগুলোও কিন্তু সেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সে জায়গায় আমাদের ছাত্র সমাজের মাধ্যমেই একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এই ছাত্রদের ওপর আস্থা রেখেই জনগণ রাস্তায় নেমে এসেছে। এখন আমাদের ছাত্র সমাজই যেহেতু সরকার এবং রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে কথা বলছে, আমি আশা করব আমাদের সাধারণ জনগণও এই ছাত্র সমাজের ওপর আস্থা রাখবে।
তিনি বলেন, আমাদের উপদেষ্টা প্যানেলে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ ব্যক্তিদের মনোনীত করেছি এবং ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমরা দুজন উপদেষ্টা মনোনীত হয়েছি। এর পাশাপাশি উপদেষ্টাদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে ছাত্ররা কাজ করার সুযোগ পাবে।
নাহিদ আরও বলেন, বর্তমান সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। যেহেতু আমরা আজই দায়িত্ব বুঝে নিয়েছি, আমরা আজ থেকেই কাজ শুরু করব। আশা করছি দুই-এক দিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমরা এখন থেকেই পুরোদমে কাজ শুরু করে দেব।