গোপালগঞ্জ জেলায় এক বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১ হাজার ৩৩১ মেট্রিক টন ২৫০ কেজি । খাল, বিল, জলাভূমি ও নদীবেষ্টিত এই জেলার ৫ উপজেলায় মৎস্য অধিদপ্তরের তত্ত্ববধানে মিঠা পানির মাছ চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এ কারণে প্রতি বছরই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এই সেক্টরে জেলার অন্তত ৬৫ হাজার মানুষের কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। মৎস্য চাষ বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই চাঙ্গা। জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ জেলার ৫ উপজেলায় ২২৯ টি বিল ও জলাভূমি, ১০ টি নদী, ৬টি বাওড় ও ৩৩৪ টি খাল রয়েছে। এসব উৎস হতে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ৪০ হাজার ৬৮৪ মেট্রিব টন ৯৩০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়। ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে জেলায় ৪২ হাজার ১৬ মেট্রিক টন ১৮০ কেজি মাছ উৎপাদিত হয়েছে । সেই হিসাবে বিগত ১ বছরে জেলায় মাছের উৎপাদন বেড়েছে ১ হাজার ৩৩১ মেট্রিক টন ২৫০ কেজি। খাল,বিল, নদী ও বাওড়ে ১১ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন ৭৬০ কেজি পুঁটি, ট্যাংরা, শৈল, মাগুর, কই, শিং, টাকি, খলিশা, গজার, রুই, কাতলা, বোয়াল, আইড়, চিংড়ি, ইলিশ, নান্দেল সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়েছে। ১৯ হাজার ৩৫০টি বেসরকারি পুকুর ও ১৩২টি সরকারী খাস পুকুরে ১৭ হাজার ১৫৮ জন খামারী ৩০ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন ৪২০ কেজি রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া, গ্রাসকার্প, কই, শিং, পাবদা,গুলশা ট্যাংরা, উৎপাদন করেন। এছাড়া ২ হাজার ৩৭৫ চিংড়ি ঘেরে ১০০০ খামারী ৮৩৪ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন করেন। সব মিলিয়ে জেলায় ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে ৪২ হাজার ১৬ মেট্রিক টন ১৮০ মাছ উৎপাদিত হয়। প্রতি কেজি মাছ গড়ে ২ শ’ টাকা দরে খামারী ও মৎস্যজীবীরা বিক্রি করেন। সে হিসেবে এ জেলায় ৮ শ’ ৪০ কোটি ৩২ লাখ ৩৬ হাজার টাকার মাছ উৎপাদিত হয়। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজন কুমার নন্দী বলেন, জেলার টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া, সদর, মুকসুদপুর ও কাশিয়ানী উপজেলার বিশাল এলাকা জলাভূমি বেষ্টিত। এসব এলাকায় মাছ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে মৎস্য চাষিরা মাছ চাষ সম্প্রসারণ করছেন। এক বছরে এই জেলায় ১ হাজার ৩৩১ মেট্রিক টন ২৫০ কেজি মাছের উৎপাদন বেড়েছে । জলাভূমি এলাকার জমির মালিকরা মাছ ও ধান চাষের ওপর জোর দিয়েছে। তারা জমিতে ঘের তৈরী করে বর্ষা মৌসুমে মাছ চাষ করছেন। আর শুস্ক মৌসুমে ধান চাষ করছেন। এছাড়া ঘের পাড়ে সবজির আবাদ করে অতিরিক্ত আয় করছেন। অনেকে আবার সারা বছর মাছ চাষ করছেন। এতে মৎস খামরীর আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৎস্য খামারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে জেলার ৪৫ হাজার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। কোটালীপাড়া উপজেলার কান্দি গ্রামের মৎস্যচাষী সুরেশ মধু বলেন, আমি মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছি। আমরা বিলের শ্যাওলা , গমের ভুষি ও চালের কুড়া দিয়ে কার্প জাতীয় মাছ চাষ করি। তাই আমাদের মাছের স্বাদ নদী বা বিলের মাছের মতই। সারাদেশে আমাদের মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মাছ চাষ লাভজনক ব্যসায় পরিণত হয়েছে। এ কারণে আমি প্রতি বছরই মৎস্য অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় মাছ চাষ সম্প্রসারণ করছি। আমর মাছ চাষের সাফল্য দেখে অনেকেই মাছ চাষে ঝুঁকছেন। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার নিজড়া গ্রামের মৎস্য চাষি আদিল খাঁ বলেন, মৎস্য খাদ্যের দাম বেড়েছে। আমরা মৎস্য খাদ্য নির্ভর মাছ চাষ করলে লাভবান হতে পারতাম না। বিলে আমার ঘের। এখানে ন্যাচারাল পরিবেশে ও বিলের শ্যওলা সহ অন্যান্য খাবার দিয়ে খুব কম খরচে আমরা মাছ উৎপাদন করি। তাই এ মাছ চাষে আমাদের লাভ থাকে। এখন পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। তাই আমরা সরাসরি ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মাছ বিক্রি করে আরো বেশি টাকা আয় করতে পরছি। মৎস্য খাদ্য নির্ভর খামারীদের কথা চিন্তা করে মাছের খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার দাবি জানান ওই মৎস্য খামারী। নতুন মৎস্য চাষি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার করপাড়া গ্রামের জামাল শেখ বলেন, আমার বিলের জমিতে বছরে একবার বোরো ধান ফলত। তারপর ৭ মাস জমি জলমগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকত। এতে আমদের কোন আয় হত না। আমি জমি কেটে ২ বছর আগে মাছের ঘের করেছি। এখানে মাছ চাষের পাশাপাশি একই ঘেরে ধান ও সবজি আবাদ করছি। সার বছরই এই খামার থেকে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাশিয়ানী উপজেলার সিতারামপুর গ্রামের শ্রমিক সোবহান সরদার (৪৫)বলেন, মাছ চাষ বেড়েছে। তাই মৎস্য খামারে আমাদের কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি হয়েছে। এখান থেকে মাসে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছি। পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে সংসার চালাতে পারছি। মুকসুদপুর উপজেলার উজানী গ্রামের মৎস্য চাষি আব্দুর রহমান বলেন, মাছ চাষে আমাদের এলাকায় অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তারা মৎস্য খামারে মাছ, ধান ও সবজি চাষের কাজ করছেন। এখান থেকে তারা প্রতিদিন ৬ শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন।