সাম্প্রতিক সহিংসতায় খুনের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাদের বিচার করতে হবে, তা না হলে মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না।
রোববার (২৮ জুলাই) দুপুরে গণভবনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার চেষ্টা থাকবে যারা এই খুনের সঙ্গে জড়িত, খুঁজে খুঁজে বের করে তারা অবশ্যই যেন শাস্তি পায়—সেটাই আমার প্রচেষ্টা থাকবে, আমি সেটাই করবো। ’
তিনি বলেন, ‘মানুষ কী দোষ করলো যে এভাবে মানুষ খুন করতে হবে! মানুষ খুন করে সরকার পতন—এটা কবে হয়, কখন হয়? সাধারণ মানুষ কী দোষ করেছে?’
অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে নিহতদের স্বজনদের সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদেরও সাহায্য চাই। যদি আপনারা কিছু জানেন আমাদের জানাবেন। কারণ, এভাবে বারবার বাংলাদেশটাকে নিয়ে খেলা এটা আর হতে দেওয়া যায় না। কাজেই আমি আপনাদেরই সাহায্য চাই। ’তিনি বলেন, ‘মানুষ মেরে লাশ ঝুলিয়ে রাখার মতো এই বর্বরতা, জানোয়ারের মতো ব্যবহার এটা কি কেউ করতে পারে? একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের লাশ ঝুলিয়ে রাখবে পা বেঁধে! যারা এগুলোর সঙ্গে জড়িত অবশ্যই তাদের বিচার হবে। তাদের বিচার করতে হবে, তা না হলে মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না। ’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন প্রত্যেকটা জিনিস পুড়িয়ে-জ্বালিয়ে চারখার করে দিয়েছে। যেখানে মানুষ সেবা পাবে সেই জায়গাগুলো, সেই কোভিড হাসপাতাল থেকে শুরু করে যে যে জায়গায় আমরা মানুষের জন্য কাজ করবো সেই জায়গা, প্রত্যেকটা জায়গা একে একে পুড়িয়ে দেওয়া; আর এই ভাবে গুলি করে মানুষকে মারা। ’
স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যদের শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের কাছে শুধু এইটুকু বলবো, আপনারা সবর করেন। আর আল্লাহকে ডাকেন যেন এই সমস্ত খুনি-জালেম, এদের হাত থেকে আমাদের দেশটা যেন রেহাই পায়। ’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দাবি মানা এবং ধৈর্য ধরে তাদের বোঝানো হয়েছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ধৈর্য ধরে সব সময় তাদের বোঝানো, তাদের সঙ্গে কথা বলা, সব চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজকে চারদিকে এই হাহাকার। এটা তো সহ্য করা কষ্টকর। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা আন্দোলন করেছে, তাদের সব দাবিই তো মেনে নিয়েছি। তাতেও নাকি দাবি শেষ হয় না। একটা মানি তো আরেকটা। তারপর আরও দুইটা। আবার চারটা। আবার আটটা। এ কী? বারবার বলেছি যে ঠিক আছে, আমরা দেখছি। যা দাবি সবই তো মানলাম। ’
সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের পরিবার ও আহতদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যতক্ষণ বেঁচে আছি আপনাদের পাশে আছি। আমি আসলে আপনাদের কী বলে সান্ত্বনা দেবো? শুধু এটুকু বলবো যে, আমি আপনাদের মতোই একজন। বাবা-মা, ভাই হারানো সেই এতিম। কাজেই আপনাদের কষ্ট আমি বুঝি। আমি আছি আপনাদের জন্য, আপনাদের পাশে। ’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বজন হারানোর কথা স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তো বুঝি আপনাদের কষ্ট, আপনাদের বেদনা। প্রতিনিয়ত বাপ-মা-ভাই-বোনদের হারানোর ব্যথা নিয়ে আমাদের চলতে হয়। এমনকি লাশটাও তো দেখতে পারিনি, কাফন-দাফনটাও করতে পারিনি। দেশেও ফিরতে পারিনি, ছয় বছর আসতে দেয়নি আমাকে। ’
তিনি বলেন, ‘যখন (দেশে) এসেছি, সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি। চেয়েছি যেন এদেশের মানুষের একটু—আমার বাবা বলতেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবো। আমি সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটাবে, এই সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটাবে— এটা তো কাম্য না। ’
নিহতদের স্বজনরা গণভবনে আসায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘সবাই এসেছেন কষ্ট করে, দুঃসময়ে। আজকে যদি ভালো সময় হতো কত হাসিখুশি করে সবাই যেতে পারতেন। আর এখন আমারও আপনাদের চোখের পানি দেখতে হচ্ছে। এটিই সবচেয়ে কষ্ট। ’
বক্তব্যের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বারবার আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায়।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত ৩৪ জনের পরিবার গণভবনে আসেন। এসব পরিবারের সদস্যদের হাতে আর্থিক সহায়তা হিসেবে পারিবারিক সঞ্চয়পত্র এবং নগদ অর্থ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতায় নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের খোঁজ-খবর নেন। অনেকে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অশ্রুসজল হতে দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এ সময় গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
নিহতদের পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার সময় অশ্রুসজল প্রধানমন্ত্রী তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আমাকে দেখেন, আমি কত শোক নিয়ে বেঁচে আছি। ’
এ সময় গণভবনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রমুখ।