সরকারের একক প্রচেষ্টায় শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট অংশিজনদের সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। সরকার শিশুশ্রম নিরসনে গৃহীত কার্যক্রম বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করছে। শিশুশ্রম নিরসনে কাঙ্খিত সাফল্য না এলেও রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোন ঘাটতি নেই। ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রমমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। ঠাকুরগাঁও জেলাকে দেশের প্রথম শিশুশ্রমমুক্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা দেয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া রাজশাহীসহ আরো কয়েকটি জেলাকে শিশুশ্রমমুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে এক বছরের মধ্যে আরো কয়েকটি জেলা ও উপজেলাকে শিশুশ্রমমুক্ত করা সম্ভব হবে। আজ (১৩ জুলাই, ২০২৪ শনিবার) ঢাকার এফডিসিতে শিশুশ্রম প্রতিরোধে করণীয় নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো: নজরুল ইসলাম চৌধুরী, এমপি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। বিশেষ অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, যে বয়সে শিশুদের হাতে থাকার কথা বই খাতা, সেই বয়সে অনেক শিশুকে জীবন সংগ্রামের জন্য হাতে তুলে নিচ্ছে শ্রমের হাতিয়ার। নিজের কিংবা পরিবারের দু’মুঠো খাবারের জন্য বেছে নিচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এদের মধ্যে অনেকেই ওয়েল্ডিং, লোহা—ইস্পাত ঝালাই, মটরগাড়ির ওয়ার্কশপ, জুতার কারখানা, বিড়ি তৈরি, টেইলারিংসহ বিভিন্ন অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। এমনও দেখা গিয়েছে যে কোমল দুটি হাতে বই থাকার কথা সেই দুটি হাত দিয়ে রিক্সা বা ভ্যানগাড়ি চালাচ্ছে। টেম্পুর হেলপারি করছে। মাথায় করে ইটের বোঝা বহন করছে। আমাদের আইনে শিশুশ্রম নিমূর্লে নানা পদক্ষেপের কথা বলা থাকলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যদি আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে এসডিজি’র গোল ৮ অর্জন হবে না। শিশুশ্রম নিরসনে সরকারি সংস্থাসমুহ ও এনজিও’র মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। গত ২ দশকে শিশুশ্রম নিরসনে কি পরিমাণ টাকা বিদেশ থেকে এসেছে, সঠিকভাবে তা ব্যয় হয়েছে কিনা যাচাই করা উচিৎ।
তিনি আরো বলেন, সারা দেশে ৩৪ লাখেরও বেশি পথশিশু রয়েছে। যারা অনাহারে, অনাদরে বাবা—মা, অভিভাবকের যত্ন ছাড়াই রাস্তাঘাট, বাস স্টেশন, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনে বেড়ে উঠছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই কুলীর কাজ, ভাংগারী সংগ্রহ কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি করছে। শীত, গরম, ঝড়, বৃষ্টি কোনকিছুতেই তাদের থাকার কোন নিরাপদ আশ্রয় নেই। পরিত্যাক্ত এসব শিশুরা নানা রকম শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। তাই শিশু শ্রম নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন সংস্থা সুশীল সমাজসহ বিত্তশালীদের সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। তবে শিশু শ্রম বন্ধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে যত উন্নয়নই হোক না কেন, যদি আমরা পথশিশুদের সুরক্ষাসহ শিশুশ্রম বন্ধ করতে না পারি তাহলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে না।
শিশুশ্রম নিরসনে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ উপস্থাপন করছে:— ১) জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি ২০১০ সংশোধন ও আধুনিকায়ন করা ২) দারিদ্রতা দূর করে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিশুশ্রম দূর করার পদক্ষেপ নেয়া ৩) মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় শিশুশ্রম নিরোধে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে স্কুলে মিড—ডে মিল চালু করা ৪) শিশুশ্রম নিরসনে চলমান প্রকল্প সমূহের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন ও সমাপনী মূল্যায়ন আইএমইডি এর মাধ্যমে সম্পন্ন করা ৫) অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গণমাধ্যমের সাথে এনগেজমেন্ট আরো বেশি বৃদ্ধি করা ৬) শিশু শ্রমিকদের তথ্য সম্বলিত ডিজিটাল ডাটা ব্যাংক তৈরি করা ৭) শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শিশুশ্রম ইউনিটের জনবল বাড়িয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা ৮) শিশুশ্রম নিরসনে কর্মরত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, এনজিও, আইএনজিও ও দাতা সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা ৯) অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কোন শিশুকে কেউ নিয়োজিত করলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জেল জরিমানার মাধ্যমে আইনের আওতায় আনা ১০) পথশিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কর্মমূখী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে শিশুশ্রমের মূল কারণ কেবল দারিদ্র্য নয়” শীর্ষক ছায়া সংসদে কবি নজরুল সরকারি কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের বিতার্কিকরা চ্যাম্পিয়ন হয়। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো: আব্দুর রহিম খান, আইএলও বাংলাদেশ এর অফিসার ইনচার্জ নীরান রামজুথান এবং এডুকো বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুল হামিদ। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, প্রফেসর এ.কে.এম মাজহারুল ইসলাম, উপসচিব রোকেয়া পারভীন জুই, শিশু অধিকার গবেষক ড. এস এম মোর্শেদ ও সাংবাদিক ঝুমুর বারী। প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন দলকে ৫০ হাজার ও রানারআপ দলকে ২৫ হাজার টাকাসহ ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়। প্রতিযোগিতাটি আয়োজনে সহযোগিতা করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, আইএলও ও এডুকো বাংলাদেশ।