অনলাইনে অ্যাপস থেকে টিকিট কিনে দিনে ৫০০ টাকা আয়। এমন চমৎকার সুযোগ কে ছাড়তে চায়? রাজধানীর কদমতলীর যুবক রিমন সরকারও (ছদ্মনাম) এমন সুযোগ ছাড়েননি। প্রথম দিকে কিছু টাকা আয়ও করেছিলেন। ফলে কয়েকদিন পর তার জমানো লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন এই খাতে। ভেবেছিলেন কয়েক মাস পর লাভসহ পুরো টাকা তুলে নেবেন। কিন্তু সেই সুযোগ আর পাননি রিমন। কারণ মাস যেতেই সেই অ্যাপস ও তার সাথে যুক্ত সবাই হাওয়া।
শুধু রিমন সরকারই নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তার মতো ৪০ হাজার মানুষ ‘ই-মুভি প্ল্যান’ নামের ওই অ্যাপসে বিনিয়োগ করে, যার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩২ জন তরুণ-তরুণীর মাধ্যমে এই প্রতারণার জাল বিস্তার করা হয়। এক মাসের মাথায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অ্যাপসটি বন্ধ হয়ে যায় এবং ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় প্রতারক চক্র।
প্রথম শুরু হয় রাজশাহী জেলা শহরের শিরোইল কলোনি থেকে। পরে উত্তরের বিভিন্ন জেলার মাধ্যমে ঢাকায় পৌঁছে‘ই-মুভি প্ল্যান’। মোট ১৬টি জেলায় এর কার্যক্রম বিস্তার লাভ করেছিল। এক বছর আগে রাজধানীর বাংলামটরের সেল রোজ এন ডেল নামের একটি ভবন থেকে এর কার্যক্রম চালানো হতো। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রতারণার শিকার হলেও কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ না করায় চক্রটির কোনো সদস্যকে পুলিশ ধরতে পারেনি।
এই চক্রের প্রলোভনে পড়েছিলেন রাজশাহীর কাজলা এলাকার আকতারুজ্জামান টনি। তিনি এক সময় বালুর ব্যবসা করতেন। কিন্তু ‘ই-মুভি প্ল্যানে’র ফাঁদে পা দিয়ে সেখানে অ্যাকাউন্ট খোলেন। এরপর টাকা ডলারে রূপান্তর করে টিকিট কিনতে শুরু করেন তিনি। কয়েকদিন টাকা আয়ও করেছিলেন। পরে ধাপে ধাপে ৯ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন, যার পুরোটাই হারিয়েছেন।
তবে জানা গেছে, রাজশাহীর আজমুল হুদা মানিক নামের এক ব্যক্তি ‘ই-মুভি প্ল্যানে’র রাজশাহী সিটি পার্টনার হিসেবে কাজ করতেন। সেই এজেন্টকে এখন খুঁজে পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এই মানিকের গ্রামের বাড়ি নওগাঁর মান্দাইল বিলমুদ্রাইলে। ‘ই-মুভি প্ল্যানে’র গ্রাহক সংগ্রহের জন্য ‘দ্যা ভয়েস অব স্পিরিট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারণা চালানো হতো, যেটি পরিচালিত হতো নাটোরের আব্দুলপুর থেকে সালেক আলী নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে।
সারাদেশে যে ৩২ জন ‘ই-মুভি প্ল্যান’ অ্যাপস ও সাইটের মাধ্যমে টিকিট কিনতে সবাইকে প্রলুব্ধ করতেন তারা হলেন- আনোয়ার হোসাইন, আসিফা ফাইজা, রাশিদুল ইসলাম, ইসমাইল হোসাইন, ইয়াসিকা সিদ্দিকী, সালাম, তোফায়েল আহমেদ, ফারহান আহমেদ, সাইদুল ইসলাম অভি, তৌফিক আহমেদ, সুমন আলম, কায়েস হোসাইন, আল ফায়েদ, আব্দুর রহিম, এসকে ফারহান, সোহেল মুন্সি, রায়হান আহমেদ, আবির হোসাইন, আব্বাস উদ্দিন, মইনুল হোসাইন, রবিন খান, এসকে আব্বাস, ইসরাত জাহান লিসা, সাইফুল ইসলাম, সায়াফ আহমেদ, ওয়ালিউল ইসলাম, মাহমুদুল হোসাইন, ফজলে রাব্বী, ওমর ফারুক মোল্লাসহ আরও কয়েকজন। তারাই মূলত সারাদেশে জ্যামিতিকহারে গ্রাহক বাড়িয়ে টিকিট কিনতে গ্রাহকদের উৎসাহিত করতেন।
জানা গেছে, এখানে বিনিয়োগ করলে লাভ আসবে এবং আয় হবে- এমন প্রচারণা চালাতেন মূলত মাইকেল নামের এক ব্যক্তি। টেলিগ্রামে বিদেশি কর্মকর্তা দাবি করে ভুয়া ছবি দিয়ে খোলা হয়েছিল মু জি লির নামের একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট। এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিচয়ে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হওয়া দুই চীনা নাগরিকও এখন লাপাত্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এ বিষয়ে সেভাবে কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের অভিযোগ পাইনি। আমরা মূলত ওপেন সোর্স থেকে পাওয়া তথ্য আমলে নিয়ে কাজ করছি।তিনি আরও বলেন, আমরা কাজ করছি, তবে বলার মতো পর্যায় এখনো আসেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল) মুহাম্মদ সাঈদ আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, আসলে জিনিসটা তো আমাদের রিলিটেড না। তারপরও আমরা বিটিআরসিকে বলেছিলাম তদন্ত করতে। সেই সাইট ব্লক করে দেয়া হয়েছে। আর এ ঘটনার সাথে জড়িত কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, আমরা মিডিয়াকর্মীদের কাছ থেকে তথ্য ও অভিযোগ পাই কিন্তু কোনো ভুক্তভোগী বা ব্যক্তি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে অভিযোগ দেননি। বিষয়টি নিয়ে সিআইডি কাজ করছে। তারা তাদের মতো করে তদন্ত করছে বলে যতটুকু জানি। সেই ৩২ জনের কোনো হদিস মেলেনি। এছাড়াও যে অ্যাপস ব্যবহার করে এর কার্যক্রম চালানো হয়েছিল সেটি বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রণ ও সেখানেই তৈরি করা হয়েছিল বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোঁজ নিয়ে জেনেছে।