সাতক্ষীরার কলারোয়ার নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশিয় দোসরদের হাতে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিকামী জনতার গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন উপজেলার একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বর্তমানে অযত্ন-অবহেলা আর অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে চিহ্নিত অধিকাংশ গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো। এছাড়া সংশিষ্ট মহলের এ বিষয়ে দীর্ঘদিন কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, ৭১’র গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা না হলে বর্তমান এবং নতুন প্রজন্ম কলারোয়ার মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস অজানা থেকে যাবে।
এদিকে স্থানীয় সুশীল সমাজের দাবি, বছরের বিশেষ একটি দিনে নয়, কলারোয়ার চিহ্নিত গণকবর, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ, ভূমিদস্যুদের কবল থেকে রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ এবং উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা শহীদের গণকবরের সঠিক সন্ধান ও সংরক্ষণের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়ার সঠিক ইতিহাস জানতে আগ্রহী করে তোলা।
‘মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বই থেকে জানা গেছে, ১৯৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধে ৮নং সেক্টরের আওতাধীন কলারোয়া উপজেলার ৩৪৩জন কৃতি সন্তান মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ২৭জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বিজয়ের ১০দিন আগেই ৬ ডিসেম্বর কলারোয়ার মাটি পাক-হানাদারমুক্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা কলারোয়া থানার ভিতরে স্বাধীন দেশের লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করে শত্রুমুক্ত করে প্রিয় জন্মভূমিকে।
কলারোয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯থেকে ১০টি সম্মুখযুদ্ধে লড়াই করেছেন। এসময় পাকবাহিনী এ দেশিয় দোসরদের সহযোগিতায় গণহত্যা ও সম্মুখযুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ মাটিতে পুঁতে রেখে দেয় নরপশু পাকসেনারা। কলারোয়া উপজেলায় এ পর্যন্ত ৯টি গণকবরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে।
এরমধ্যে কলারোয়া পৌরসদরে উত্তর মুরারীকাটির পাল পাড়ায় (৯জন), কলারোয়া পাইলট হাইস্কুল ফুটবল মাঠের দক্ষিণে (৫জন), সোনাবাড়ীয়া মঠমন্দির এলাকায় (৩জন) সোনাবাড়ীয়া মোড়ে (৩জন), ভাদিয়ালীতে (৪জন), বামনখালী ঘোষ পাড়ায় (৩জন), চন্দনপুর গয়ড়া বাজারে (২জন), কেঁড়াগাছির বালিয়াডাঙ্গা বাজারে (৭জন) ও পার্শ্ববতী যশোর জেলার শার্শা থানার জামতলা বাজারের সন্নিকটে (৫জন)।
তবে এসব অধিকাংশ গণকবরই পড়ে আছে অযত্ন আর অবেহলায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বই সুত্রে আরো জানা যায়, ১৯৭১’র ২৮ এপ্রিল পাক-হানাদার বাহিনী কলারোয়া পৌরসদরের উত্তর মুরারীকাটি পালপাড়ায় বৈদ্যনাথ পাল, নিতাইপাল, বিমলপাল, সতীশপাল, রামপাল, গাটুপাল, অনিলপাল, গোপালপাল ও রঞ্জনপালকে (৯জন) সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে গুলিকরে হত্যা করা হয় (স্বাধীনতা পরবর্তীতে বেশ কয়েক বছর পর গণকবরটি স্থানান্তর করা হয়)।
এছাড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী বালিয়াডাঙ্গা বাজারে তিন রাস্তা মোড়ে গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন ৭জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে
সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করা হলেও স্থানীয়রা জমি দখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। যার কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে স্মৃতিস্তম্ভটি। উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী ভাদিয়ালী গ্রামে বাংলাদেশ-ভারত বিভক্তকারী সোনাই নদীর তীরে ৪জন শহীদের গণকবর রয়েছে।
উপজেলার সোনাবাড়িয়া মোড়ে গণকবরে শায়িত আছে ২জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, একই এলাকায় মঠ মন্দির সংলগ্ন স্থানে রাজাকাররা ৩জন বীর সেনানীকে হত্যার পর মাটি চাপা দিয়ে রাখে। উপজেলার বামনখালী ঘোষপাড়ায় ৩জনকে পাক-হানাদাররা হত্যার পর মাটিতে পুঁতে রাখে।
এদিকে পাক-বাহিনী তাদের এদেশিয় দোসরদের সহযোগিতায় কলারোয়া থানার পিছনে (সরকারি হাইস্কুল ফুটবল মাঠের দক্ষিনে)
৫জন বীর সেনানীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তবে এরমধ্যে একজন জীবিত থাকলেও ওই স্থানে তাকে জীবিত অবস্থায়সহ ৫জন শহীদকে স্থানীয় মজুরদের দিয়ে গর্ত করিয়ে মাটি চাপা দেয়।
সেসময় গণকবর খননকারী কলারোয়ার মজুর প্রয়াত অমেদালী মৃত্যুর আগে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, মাটি চাঁপা দেয়ার পূর্বে ১জন তরুণ গুলিবিদ্ধের পরও জীবিত ছিল, তারপরও নরপশুরা ওই তরুণকে জীবন্ত মাটি চাপা দেয়।
এরআগে একজন অধ্যাপকসহ খুলনা দৌলতপুর বিএল কলেজের কয়েকজন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ভারত যাওয়ার পথে কলারোয়া-সরসকাটি সড়কের বামনখালী বাজারে পাক-বাহিনীর হাতে তারা আটক হয়। এরা সবাই ছিলেন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা।
পরবর্তীতে তাদের থানায় নিয়ে আসার পথে অধ্যাপকসহ ৩/৪ জন পালিয়ে যেতে স্বক্ষম হলেও ৫জন শহীদকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। এছাড়া উপজেলার পাঁচনল গ্রামের মতিয়ার, রশিদ, শামসুসহ ৬জনকে পাক-বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পরে পার্শ্ববতী শার্শার জামতলা বাজারের সন্নিকটে নেয়ার পথে পাক-হায়েনাদের কবল থেকে শামসুর রহমান পালিয়ে আসতে স্বক্ষম হলেও অন্য ৫জনকে হত্যা করে সেখানে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কলারোয়া থানার পিছনের গণকবরটিতে শুধুমাত্র জাতীয় দিবসে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। তবে বর্তমানে সেখানে নামফলক ও টাইলস বসিয়ে এটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড।
যদিও বছরের বিশেষ একটি দিন ছাড়া ময়লা-অপরিস্কার অবস্থায় পড়ে থাকে শহীদদের এই গণকবরটি। এছাড়া কলারোয়ার ভারত সীমান্তবর্তী চন্দনপুর ইউনিয়নের গয়ড়া বাজারের শহীদ মিনারের পাশে গণকবরে শায়িত রয়েছেন-বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ নূর মোহাম্মদ ও এলাহী বক্স। স্থানীয়দের তত্ত্বাধানে মোটামুটি সংরক্ষিত আছে এই গণকবরটি।
উপজেলার খোর্দ্দ-পাকুড়িয়া গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেনের কবর রয়েছে, তবে এলাকার অনেকেই এ কবরের স্থান সম্পর্কে জানেন না। এভাবে কলারোয়া উপজেলার সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের গণকবর। যেগুলো সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতার কারণে আজও তালাশ হয়নি। এমনকি মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসেও অনেক শহীদদের গণকবরে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি জোটেনা।
এছাড়া ভূমিদস্যুদের দখল, অবহেলা আর অযত্নের কারণে অধিকাংশ গণকবর ও বধ্যভূমির অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন। উপজেলার সুশিল সমাজ ও সচেতন মহল অবিলম্বে শহীদদের এসব গণকবর যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও নতুন গণকবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করে উপজেলার নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধে কলারোয়া উপজেলার বীরত্বগাঁথা ইতিহাস জানতে সহযোগিতা করার দাবি জানান।
জানতে চাইলে কলারোয়া উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা জানান, উপজেলায় শহীদদের গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে বালিয়াডাঙ্গা বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী এবং কলারোয়া থানার পিছনে গণকবর টাইলস বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরো কয়েটি স্থানে সংস্কার কাজ করা হয়েছে। এছাড়া অতিদ্রæত চিহ্নিত সব গণকবর ও বধ্যভুমি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হবে।
কলারোয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক রুলী বিশ্বাস জানান, অতি দ্রুত এসব অবৈধ দখলকারীদের উচ্ছেদ করে বীর শহীদদের গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।