আমার মরণ করোনাই হবে কে বলছে? গাড়ি দুর্ঘটনায় তো হতে পারে। কাঁঠালবাড়িতে স্পিডবোট ডুবে মানুষ মরেছে; সেভাবেও হতে পারে। কাজেই মৃত্যুকে ভয় পাই না। মায়ের সঙ্গে ঈদ করুম। যত কষ্টই হোক, বাড়ি যামু।
বরিশালের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে এভাবেই কথাগুলো বলেছেন পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার রেশমা আক্তার। তার সঙ্গে রয়েছেন তানিয়া, সাথী ও শিমু। তারা গাজীপুরের তিনটি পোশাক কারখানায় কাজ করলেও একই বাসায় থাকেন। মঙ্গলবার বেতন পেয়ে বুধবার (১২ মে) ভোররাত ৪টায় বাড়িতে সড়কপথে রওনা দিয়েছেন।
রেশমা বলেন, ঢাকা থেকে বাসে করে মাওয়া ঘাটে এসেছি। ৪০০ টাকা দিয়ে ট্রলারে পদ্মা নদী পাড়ি দিলাম। পিকআপে বরিশালে নামলাম। মাওয়া থেকে বরিশাল নথুল্লাবাদ পিকআপে ভাড়া নিয়েছে ৫০০ টাকা। এখান থেকে লেবুখালি ফেরিঘাট দেড়শ টাকা ভাড়া চাচ্ছে। সেখান থেকে ওপারে উঠে আবার দুই বা তিনশ টাকা লাগবে বাড়ি পৌঁছাতে। কষ্ট তো কম করিনি।
রেশমা, তানিয়া, সাথী ও শিমুর মতো লাখ লাখ মানুষ দক্ষিণাঞ্চলে ফিরছেন ভোগান্তি নিয়ে। বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা এসব মানুষের নেই করোনাভীতি।
ঢাকা থেকে ১৩ স্থানে গাড়ি পরিবর্তন করেছেন কাঁঠালিয়া সদর ইউনিয়নের ব্যাপারী বাড়ির রুস্তম ব্যাপারী। তিনি বলেন, ফেরিতে পদ্মা পার হলেও অটোরিকশা, সিএনজি, টমটম আর বাসে করে আসতে ১৩ স্থানে আমি গাড়ি পরিবর্তন করেছি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথের নিরাপত্তাকর্মী রুস্তম বলেন, গত বছর আমি বাড়ি না আসায় বাড়ির মানুষের ঈদ হয়নি। তখন করোনাকে ভয় পেয়েছিলাম। এবার আর ভয় পাই না। পোলাপানরে নতুন জামা না দিতে পারলে কষ্ট কইরা চাকরি করার কোনো মানে নেই।
রুস্তমের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছেন নলছিটি উপজেলার ষাটপাকিয়া এলাকার বাসিন্দা নাজমা বেগম। নাজমা বলেন, এইটা জীবনের শেষ ঈদ মনে কইরাই ঢাকা ছাড়ছি। করোনা যেমন সত্য; ঈদ তো সত্য।
তবে বিগত যেকোনো বছরের তুলনায় এ বছর ঈদে বাড়ি ফেরায় বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে জানান এই নারী। তিনি বলেন, লঞ্চ চললে সুবিধা হতো। সড়কপথে আসতে গিয়ে যে টাকা খরচ হয়েছে; তাতে ঈদের বাজার করতে পারতাম।
নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় পিকআপচালক মোহাম্মদ আলী ও বাবু মিয়ার সঙ্গে। কাঁঠালবাড়ি থেকে ১৭ জন যাত্রী নিয়ে এসে পৌঁছেছেন বিকেল সাড়ে ৩টায়।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ৪০০ টাকা করে জন প্রতি নিয়েছি। মূল সড়ক দিয়ে আসতে পারিনি। যাত্রী নিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে আসতে হয়। মহাসড়কে এলে পুলিশে ধরে।
তার সহযোগী বাবু বলেন, রাত-দিন মিলিয়ে তিন ট্রিপ দেওয়া যায়। তাতে যা আয় হয় তার চেয়ে পরিশ্রম বেশি হয়। কাঁঠালবাড়িতে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট আছে। তাদের টাকা দিলে আগে সিরিয়াল পাওয়া যায়। আর না দিলে গাড়ি সড়কেই রাখতে দেয় না।
শুধু পিকআপ নয়; থ্রি-হুইলারে করেও মাওয়া থেকে বরিশালে আসছে মানুষ। জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে যাত্রী নিয়ে সরাসরি যাতায়াত করছে থ্রি-হুইলার। নথুল্লাবাদে থ্রি-হুইলারচালক রফিকুল ইসলাম জানান, এর আগে তিনি বানারিপাড়া-বরিশাল রুটে গাড়ি চালাতেন। কিন্তু ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে তিনি মাওয়া-বরিশাল রুটে থ্রি-হুইলারে করে যাত্রী আনা-নেওয়া করছেন।
হারুন নামে আরেক সিএনজিচালক জানান, এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে যাত্রী নিয়ে চলাচল করছেন। এতে সুবিধা হলো সারাদিন গাড়ি চালানো লাগে না। আপ-ডাউনে দুটি ট্রিপ দিতে পারলেই ১২ হাজার টাকা আয় হয়।
পিকআপ পণ্য পরিবহনের জন্য হলেও যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দেয়নি বিআরটিএ। থ্রি-হুইলার মহাসড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সরেজমিনে বরিশাল নগরীর রূপাতলী, নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড, গড়িয়ার পাড়, রহমতপুর, উজিরপুর ও গৌরনদীর মহাসড়ক ঘুরে দেখা যায়, ঈদযাত্রায় মহাসড়ক দখল করে রেখেছে অবৈধ পিকআপ ও থ্রি-হুইলার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক জিয়াউর রহমান বলেন, পিকআপ বা ট্রাকে কোনো অবস্থায় যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। পণ্য বহন করতে যেসব গাড়িকে অনুমতি দেওয়া হয়; সেসব গাড়িতে যাত্রী পরিবহন আইনত নিষিদ্ধ। তারপরও কিছু গাড়ি এবং মানুষ বর্তমান প্রেক্ষাপটে ট্রাকে, পিকআপে করে চলাচল করছে। উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় মালিক সমিতির সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। চেষ্টা করছি নিয়ন্ত্রণের।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক শাহ শাজেদা বলেন, মানুষের মানসিক অবস্থা পরিবর্তন না হলে করোনা মোকাবিলা সম্ভব নয়। লকডাউনের মধ্যে মানুষ যেভাবে বাড়ি ফিরছে, সেটি আমার কাছে বিস্ময় লাগে। আজ ফেরিতে মানুষের চাপে ৫-৬ জন মারা গেছেন। করোনাকালীন মানুষের এমন আচরণ কল্পনাও করা যায় না।
আর/এইচ