করোনা চিকিৎসায় অনেক কিছুই ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু কোনটাই এখন পর্যন্ত শতভাগ স্বীকৃত নয়। চিকিৎসা উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা কোনটি একেবারে নতুন কোনটি আবার শতবছর পুরনো।
শতবছরের পুরনো জিনিস হিসাবে যেটি ব্যবহার হচ্ছে তা হলো রক্তের প্লাজমা। কারণ কেউ যদি নতুন কোনও রোগে আক্রান্ত্র হয় যার পূর্বের কোনও স্মৃতি তার কাছে পূর্বে ছিল না, সেক্ষেত্রে রোগটির বিরুদ্ধে একটি শক্তি অর্জনের চেষ্টা চলে যার নাম এন্টিবডি। এই এন্টিবডি শরীরে প্রবেশকৃত জীবাণুর বিরুদ্ধে একটি স্মৃতি তৈরি করার চেষ্টা করে যা তাকে পুনরায় রোগের হাত থেকে রক্ষা করার উপায় তৈরি হয়। এই এন্টিবডি শরীরের সব জায়গায় পৌঁছানোর জন্য রক্তের সাথে মিশে থাকে যেহেতু রক্তই শরীরের সর্বত্র পৌঁছাতে পারে।
প্লাজমা কী?
রক্তের সাধারনত দুইটি অংশ, একটি হলো রক্তের কোষ বা সেল আরেকটি হলো জলীয় অংশ বা প্লাজমা। রক্তের প্লাজমাতে নানা রকমের প্রোটিনসহ অনেক কিছুই মিশ্রিত থাকে। এতে রোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার মত এন্টিবডিও মিশে থাকে। রোগ থেকে সেরে উঠা মানুষের শরীরে সাধারনত রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরধ ক্ষমতা বা এন্টিবডি তৈরি হয় তবে তা শতভাগ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই এন্টিবডি যেহেতু রক্তের প্লাজমাতে মিশে থাকে তাই প্লাজমা থেকে একে সঠিক উপায়ে পৃথক করা সম্ভব হলে তা আরেকজনের শরীরে প্রদান করা সম্ভব হয় যা প্রয়োগকৃত রোগীর ক্ষেত্রে সহায়ক হিসাবে কাজ করে।
শতবছর ধরে যখন নতুন কিছু আবির্ভূত হয়েছে তখনই এমন চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও সফল হয়েছে অনেকখানি আবার কখনও আশানুরূপ হয়নি। নতুন রোগের সঠিক চিকিৎসা না আসা পর্যন্ত এই চেষ্টা হয়ত সামনেও চলবে। তবে এবার আশার খবর হলো পৃথিবীর অনেক দেশেই এভাবে চিকিৎসার কার্যকারিতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক উপায়ে গবেষণার চেষ্টা চলছে। সামনেই হয়তো এর সমাধান বের হয়ে আসবে।
করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা
করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা এখন বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যবহার হচ্ছে। কোনও দেশ একেবারে সুনির্দিষ্ট উপায়ে প্রয়োগ করছে আবার কোনও দেশ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে এখনও গবেষণার বাইরে ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি যেহেতু এখনও সুনির্দিষ্ট কোনও প্রমাণে এর পক্ষে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিক এফডিএ থেকে অনুমতি নিয়ে বিস্তৃত একটি কাজ করছে যাতে সুস্থ হওয়া মানুষের থেকে প্লাজমা সংগ্রহ করে আক্রান্ত হওয়া মানুষের শরীরে প্রথম তিন দিনের মাঝেই প্রদান করছে। এই সংখ্যা সত্তর হাজার পার হয়েছে বলেই জানা গেছে। এতো বিপুল সংখ্যক প্লাজমা প্রদানের ফলে তারা কি কি সফলতা পেয়েছে তার হিসাব নিয়ে এখন গবেষক দল মতামত প্রদান করছেন। যাদেরকে প্রদান করা হয়েছে তাদেরকে প্রদান না করলে কি কি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা জানার উপায় নেই যেহেতু একই রকম রোগীদের প্রদান না করে চিকিৎসার কোনও রেকর্ড রাখা হয়নি। ফলে প্লাজমা পাওয়া আর না পাওয়ার মাঝে পার্থক্য করার উপায় নেই।
আর প্লাজমা পাওয়ার ফলে যেসব উপকার পাওয়া গেছে তার মাঝে মৃত্যুর হার কম বলে পাওয়া যাচ্ছে। তবে এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, আক্রান্ত হওয়ার প্রথম দিকেই প্লাজমা দেওয়াতে প্রমাণ করার সুযোগ কমে যায় রোগী বেশি খারাপ হয়ে যেত কিনা অথবা নিজ থেকেই ভালো হয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল কিনা। করোনা যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ তাই নিজ থেকে ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই অনেকের ক্ষেত্রে সম্ভব বলেই যুগ যুগ থেকে প্রমাণিত। তাই কিছুটা হলেও প্রশ্ন থেকেই যায়।
আর সবচেয়ে বড় কথা সুস্থ হওয়া সবার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে না এবং তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ কয়েকবারই উল্লেখ করেছে। আবার এন্টিবডিও নানাজনের রক্তে নানা মাত্রায় তৈরি হচ্ছে। তাই কোন পর্যায়ের প্লাজমা প্রয়োগ করলে রোগী উপকার বেশি পাচ্ছে বা পাবে তার রেকর্ড থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মায়ো ক্লিনিকের গবেষণায় এন্টিবডি দেখে নেওয়াটা তারা বাধ্যতামূলক রাখেনি যেহেতু তারা যত বেশি সংখ্যক রোগীকে প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
প্লাজমা নিয়ে বিভ্রান্তি
সম্প্রতি প্লাজমা নিয়ে এফডিএ পর পর দুই সপ্তাহে দুই ধরনের বক্তব্য প্রদান করেছে। প্রথমটিতে তারা মায়ো ক্লিনিকের এই কাজকে স্থগিত করে কিন্তু পরের সপ্তাহেই একে অনুমোদন প্রদান করে। যদিও দেশটির সিডিসির পরিচালক ও প্রধান ইমিউনলজি বিশেষজ্ঞ ফাউচি সাহেব প্লাজমা নিয়ে আশাবেঞ্জক কিছু বলেননি উপরন্তু সতর্কতামূলক বক্তব্য প্রদান করেছেন। এফডিএ কর্তৃক বক্তব্য পরিবর্তন বিশ্লেষণ করলে কিছুটা হলেও ধারনা পাওয়া যায় যে এটি আসলে তাদের দেশের সরকার প্রধানের ইচ্ছা প্রভাবিত করে এসব সিদ্ধান্ত।
প্রতারণা ও ঝুঁকির শংকা
আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় এফডিএ কর্তৃক প্রকাশিত পত্রটির শুধু হেডলাইন দেখে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে যা করোনাকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অনেক দিক দিয়েই প্রভাবিত করবে বলে মনে করা হয়। যেহেতু দেশে যেসব স্থানে প্লাজমা সংগ্রহ করা হয় সেসব স্থানের বেশিরভাগ স্থানেই এন্টিবডি দেখার ব্যবস্থা নেই তাতে মানহীন প্লাজমা দেদারসে সংগ্রহ বেড়ে যেতে পারে যেহেতু এফডিএ প্লাজমার বিষয়ে সবুজ সংকেত প্রদান করেছে। রোগী বা রোগীর স্বজনরা তাতে প্লাজমার বিষয়ে অতি উৎসাহী হবেন এবং অনেক চিকিৎসকও হয়তো এতে আস্থা খোঁজার চেষ্টা করবেন ফলে প্রতারণার ঝুঁকিও সমানভাবে বৃদ্ধি পাবে।
লেখক: ডা. আশরাফুল হক
ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউট, ঢাকা