করোনাকালীন দুর্যোগে ফসল উৎপাদন করে কাঙ্খিত মূল্য পান ময়মনসিংহের গৌরীপুরের লতিরাজ লতা চাষী মো. মিলন মিয়া। তিনি মাওহা ইউনিয়নের ঝলমলা গ্রামের হাসিম উদ্দিনের পুত্র। এবার লতিরাজ লতা চাষ করে এলাকার মডেল কৃষক হিসাবে পরিচিত লাভ করেছেন। নিজের নামের আগে যুক্ত হয়েছে লতিরাজ শব্দও। ‘লতিরাজ মিলন’ নামে খ্যাতি ছড়িয়েছেন তিনি। তার সাফল্যের কারণে আশপাশের কৃষকরাও লতিরাজ লতা চাষ করছেন। শুধু লতিরাজ লতা নয়, অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে ফসল উৎপাদন করে রীতিমত এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। পুরো বর্ষা মৌসুমে পলিথিনের মাচায় উৎপাদন করেছেন কাঁচামরিচ, টমেটো। সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি পুকুরে মাছ চাষেও সফল এই লতিরাজ মিলন। মিলন মিয়ার নিজের জমি মাত্র ৬০শতাংশ। বাণিজ্যিকভাবে লতাচাষের জন্য ১১জনের নিকট থেকে ৪৫০শতাংশ জমি বর্গা (এক বছরের চুক্তিতে) নিয়েছেন। তিনি জানান, প্রায় ২লাখ ৫০হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে লতিরাজ বারি-১জাতের লতার চারা রোপন ও জমি তৈরিতে। ইতোমধ্যে তিনি প্রায় সাড়ে ৩লাখ টাকার লতা বিক্রি করেছেন। আরও ৮ থেকে ১০লাখ টাকা বিক্রি হবে। মিলন মিয়া যখন লতা চাষ করে ঝলামলা গ্রামকে ঝলমলে করে তোলেন। তাকে দেখে মাওহা ও অচিন্তপুর ইউনিয়নের আরও অনেকেই লতা চাষ করছেন। তিনি আরও জানান, লতা নিয়ে এখন আর বাজারেও যেতে হয় না। সিলেটের পাইকারী বাজারে লতা বিক্রি হয়। আড়ৎদার নিজে এসে পুরো ক্ষেতের লতিরাজ লতা চুক্তিতে কিনে নিয়েছেন। সিলেটের পাইকার গোলাম রাব্বী জানান, স্থানীয় বাজারেরর চাহিদা পূরণ করে সিংহভাগ লতা লন্ডনে রপ্তানি করা হয়। তিনি আরও জানান, সেখানে বাংলাদেশপল্লীতে লতার চাহিদা ব্যাপক। আমরা কৃষকদেরকে উৎপাদনে আগাম টাকা দিয়েও লতা চাষ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি। মিলন মিয়ার পাশাপাশি লতা চাষ করছেন কৃষক মিরাজ আলী, আবু চান, তোতা মিয়া, হুমায়ুন কবীর, আব্দুল জলিল, লেয়াকত আলী, আব্দুস সোবহান, আহমেদ হোসেন, সোহরাব মিয়া। কৃষক ফক্কর উদ্দিন জানান, তিনি প্রতিমণ লতা ক্ষেতের আইলেই বিক্রি করছেন ১৬শ টাকা মণে। কৃষক আব্দুল মজিদ জানান, কচু আর লতা চাষে তেমন সার লাগে না। রোগ-বালাইমুক্ত ও বিষ দিতে হয় না। খরচও কম। তাই তিনি প্রতিবছর লতা ও কচু চাষ করেন। লতা উৎপাদন লাভবান হওয়ায় উপজেলার মাওহা, অচিন্তপুর, সহনাটী ও বোকাইনগরের একাংশ ও রামগোপালপুর ইউনিয়ন ব্যাপকহারে চাষ শুরু হয়েছে। শাহগঞ্জ বাজারের লতার আড়ৎদার আবুল কালাম জানান, প্রতিদিন সিলেট ও চট্টগ্রামে লতা পাঠাচ্ছেন। প্রতিমণ লতা ১৬শ থেকে ২হাজার টাকা ধরে কেনা হচ্ছে। বিক্রি কতো হবে তা বলতে পারছি না। সেখানে পাইকারী বাজারে লতা বিক্রি হয়। সবজির আরও একটি আড়ৎ রয়েছে মধ্যবাজারে আলতাব হোসেন খানের। তিনি জানান, লতার চাহিদা ব্যাপক। দামও অনেক। বিভিন্ন মোকামে লতা ক্রয় করে পাঠানো হচ্ছে সিলেটে। ভূটিয়ারকোনা আদর্শ উ”চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ বলেন, মিলন এই এলাকার তরুণদের আইডল। নারী শ্রমিক খোদেজা আক্তার জানান, সংসার গুচিয়ে যে সময়টুকু পাই, সেই সময় লতার আঁটি বানাই। এতে দৈনিক ৩শ থেকে ৫শ টাকা আসে। উপজেলা উপসহকারী কৃষি অফিসার উবায়দুল্লাহ নূরী জানান, কৃষক মিলন মিয়া ও তার আশপাশের প্রত্যেক কৃষককে লতা চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। এতে কৃষক লাভবান হচ্ছে। উৎপাদনও বাড়ছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার রাকিবুল হাসান জানান, মাওহা ইউনিয়নে অধিকাংশ কৃষক বারী-১ (লতিরাজ) জাতের কচু চাষ করেছেন। লতা উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় মিলন মিয়ার মতো আরও অনেকেই নুতনভাবে চাষ করছেন। তিনি প্রথমদিকে ৮বিঘা জমিতে লতা চাষ করেন। ইতোমধ্যে ১২মেট্টিকটন উৎপাদন হয়েছে। আরও ২০-২৫টন উৎপাদন হবে। উপজেলা কৃষি অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) নীলুফার ইয়াসমিন জলি জানান, লতাকচু আগাম জাতের চাষ করে অনেকেই দ্বিগুণ লাভ পাচ্ছেন। তখন প্রতি কেজি ১শ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি হয়। তিনি আরও জানান, আমরা কৃষকদেরকে নিয়মিত প্রশিক্ষন দিচ্ছি। কন্দাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধিনে ২০১৮-১৯অর্থবছরে এখানে ১২০ হেক্টর জমিতে কন্দাল ফসল চাষ হয়। এরমধ্যে লতিরাজ কচু ৬০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছি। এবছর ৭৪৬ হেক্টর জমিতে কন্দাল ফসল চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ১১৮ হেক্টর জমিতে শুধু লতিরাজ কচুর লতা উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিবছরই কন্দাল ফসলের চাষ বাড়চ্ছে।