পুরান ঢাকার ঝুলন বাড়ি লেনে ২০০২ সালের ২২ মে সন্ধ্যায় ৭২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিনয় কৃষ্ণ সরকার বীনাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। আলোচিত সেই মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৬ সালের ১ মার্চ পাঠানো হয় ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। হত্যাকাণ্ডের দেড় যুগ পেরিয়েছে, অথচ এখনও সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি। নির্ধারিত সময়ে বিচার শেষ না হওয়ায় মামলাটি ফের অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হয়েছে।দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২ অনুসারে, ১২০ দিনের মধ্যে মামলার বিচারকাজ নিষ্পত্তির কথা। এ সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে চূড়ান্ত বিচারে আরও ৬০ দিন সময় বাড়ানোর বিধানও রয়েছে। একইভাবে দেশের অধস্তন আদালতেও লাখো মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে আছে। ফলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা ফিকে হয়ে যাচ্ছে।রাজধানীর বনানী এলাকায় দ্য রেইনট্রি হোটেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনা দেশব্যাপী বহুল আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও বিচার শেষ হয়নি। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী, এ মামলার বিচারও ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। শুধু বিনয় কৃষ্ণ হত্যা মামলা বা বনানীর ঘটনাই নয়, লাখ লাখ মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির বিধান এখন কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। করোনাকালে এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। গত ২৬ মার্চ থেকে ১১ মে পর্যন্ত দেশের পুরো বিচার বিভাগেই বিচারকাজ বন্ধ ছিল। পরে ভার্চুয়াল আদালতে বিচারকাজ সীমিতভাবে শুরু হলেও সেখানে শুধু জামিন এবং জরুরি অন্যান্য বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেওয়া হয়। ফলে বিচার বিভাগ এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২০০৭ সালের এই দিনে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়। ওই রায়ে বিচার বিভাগ আলাদা করার লক্ষ্য পূরণে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নসহ ১২ দফা নির্দেশনা দিলেও তার অধিকাংশ বাস্তবায়ন হয়নি। যার মধ্যে বিচার বিভাগের নিজস্ব পৃথক সচিবালয়ও রয়েছে। ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ আলাদা করার সময় দেশের সব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার। বর্তমানে সেই মামলার জট এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ লাখে। এর মধ্যে অধস্তন আদালতেই বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩৫ লাখ।বিচার বিভাগ-সংশ্নিষ্টদের মতে, বিচার বিভাগ পৃথককরণ-সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ১২ দফা নির্দেশনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন জরুরি। পৃথক সচিবালয় গঠন না হওয়াটাই স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। কারণ বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, পদায়নের বিষয়গুলোতে আইন মন্ত্রণালয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে। মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা কম এবং সময়মতো সাক্ষী আদালতে হাজির না করাও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ। ঢাকার বাইরে আবাসন ও যাতায়াত, নিরাপত্তাসহ কয়েকটি সমস্যাও বিচারকদের নিত্যসঙ্গী। এ নিয়ে বিচারকদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।মামলাজট নিরসন ও বিচার বিভাগকে গতিশীল করতে সরকার সচেষ্ট রয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকারই প্রথম বিচারকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এর আওতায় কয়েকশ বিচারক অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর প্রধান উদ্দেশ্য মামলাজট কমিয়ে আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করা। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগের জন্য জেলাগুলোতে বহুতল আদালত ভবন নির্মাণ কার্যক্রম এবং বিচারকদের জন্য গাড়ি সুবিধাও নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার হচ্ছে। বিচারক নিয়োগও চলমান আছে। শিগগিরই অধস্তন আদালতে আরও ১০০ বিচারক নিয়োগ হবে। এর ফলে বিচার বিভাগে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মাসদার হোসেন বনাম সরকার মামলার যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করেন। ওই রায়ের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে ৩০১ জন বিচারক নিয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে ১০৯ জন বিচারপতি কর্মরত। এর মধ্যে আপিল বিভাগে সাতজন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ১০২ জন বিচারপতি রয়েছেন। অধস্তন আদালতে কর্মরত আছেন এক হাজার ৮০১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা।বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক সমকালকে বলেন, বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর গত কয়েক বছরে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। অধস্তন আদালতে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সংবিধানে উল্লেখ থাকার পরও উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে আইন হয়নি এখনও। আর বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটও বাড়ছে না। ফলে সুবিচার পাওয়ার আমাদের যে অধিকার, তা অনেকটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। মামলার জটও বাড়ছে। সময়মতো সাক্ষী হাজিরসহ মামলার শুনানির জন্য পৃথক তদন্ত ও প্রসিকিউশন সেল গঠনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।rতার মতে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আলাদা করার সুফল পেতে হলে বিচার বিভাগের নিজের ভূমিকা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার ফলপ্রসূ সমন্বয় অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি আশা করেন, বিচার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ বিষয়ে উদ্যোগী হবেন। যাতে আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি জনগণের জন্য ফলপ্রসূ ও অথর্বহ হয়; সেই রূপরেখার দিকে বিচার বিভাগকে এগিয়ে নিতে হবে।