সাম্প্রতিক সময়ে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষ করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে দেশে ৯৭৫ জন ধর্ষণের শিকার হন।
ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ৪৩ জন। এ সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী।
এসব ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন রোধে আমাদের দেশে কঠোর আইন আছে; কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। উপরন্তু আবার রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। যার ফলে ‘রেজাল্ট জিরো’।
ধর্ষণসহ নির্যাতনের শাস্তিগুলো দৃশ্যমান না হওয়ায় এ প্রবণতা বাড়ছে। তাদের মতে, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দোষীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রয়োজনে আলাদা কোর্ট করে ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের ত্বরিতগতিতে বিচারকার্য শেষ করতে হবে। দোষীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হলে এটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
তারা বলেন, আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। কেন এসব ঘটনা ঘটছে, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। কারণগুলো চিহ্নিত করে রাষ্ট্রকে সে ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে মন চায় না। এসব ঘটনা শুনলে রাগ লাগে।
আর ভালো লাগে না। ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনার জন্য আমরা সবাই দায়ী। ছোটবেলা থেকে একজন শিশু যে পরিবেশে বড় হওয়ার কথা, সেই সুস্থ এবং সুরক্ষিত পরিবেশ আমাদের আর নেই।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানুষ হয়ে ওঠা-এটার বড় অভাব। একটা শিশু যখন বড় হতে থাকে, তার মধ্যে যৌন প্রবৃত্তি আসতে থাকে। আগে গান, খেলাধুলাসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে একটা শিশু বড় হতো।
কিন্তু এখন সেই পরিবেশ নেই। বর্তমান সমাজে শিশু ও কিশোরদের কথা সেভাবে ভাবা হচ্ছে না।
তাদের স্কুলে নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা, নারী-পুরুষের সমতার শিক্ষা, যৌন শিক্ষা সঠিকভাবে শেখানো হচ্ছে না। সামাজিকভাবেও কিশোররা তেমন শিক্ষা পাচ্ছে না।
তিনি বলেন, নারী অবমাননার জন্য আইন রয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়েছে।
একজন ভুক্তভোগীকে সেখানে মামলা করার মতো পরিবেশ নেই। তেমনি আইনের বাস্তবায়নের জন্য কিছু জিনিস নিয়ন্ত্রণ করা সেই বিষয়গুলো নেই।
তাই আইনের সুফল মানুষ পাচ্ছে না। সাক্ষী সুরক্ষার জন্য আলাদা আইন হওয়া দরকার। আইনের সঠিক প্রয়োগের জন্য রাষ্ট্রকে জিরো টলারেন্স নীতি নিতে হবে। পর্নোগ্রাফি ও তথ্য-প্রযুক্তি আইন সঠিকভাবে প্রয়োগের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি কাউন্সেলিং বাড়াতে হবে। যুবসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না বলেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দোষীদের আদালতে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর শাস্তি প্রদান করা হলে এটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় যেসব মামলা হচ্ছে সেগুলোকে প্রলম্বিত না করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মতো আলাদা কোর্ট করে ত্বরিতগতিতে বিচারকার্য শেষ করতে হবে।
যেমন, নুসরাতেরটা হয়েছে। এভাবে সব কটি তাড়াতাড়ি হোক। তাহলে এ জঘন্য ঘটনা কমতে পারে।
তিনি বলেন, ধর্ষণ একটা রোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে ফরেনসিক ল্যাবের একটা বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মামলা কিন্তু হয় পুলিশের দ্বারা, আদালত শাস্তি নিশ্চিত করেন।
কিন্তু অভিযোগ, তদন্ত এসব করবে পুলিশ। এখানে যদি ব্যত্যয় ঘটে তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সবাইকে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে হবে।
ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য নারীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। নাগরিকদের নিরাপত্তা দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র সেই ভূমিকা পালন করছে না।
নারী ও শিশু নয়, প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
যেমন, আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস এসে তা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু আগুন যাতে না লাগে, সে ব্যাপারে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তাই। ঘটনা ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হলে কোনো লাভ নেই।
ঘটনার আগে তাদের সক্রিয় থাকতে হবে। ধর্ষণ যাতে না হয়, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ন্যক্কারজনক এসব ঘটনা বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রবীণ এ আইনজীবী বলেন, শিক্ষা-দীক্ষা-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছি। ছোটবেলায় আমরা পড়তাম, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস; সদা সত্য কথা বলিও; বয়স্কদের সম্মান করিও-এসব শিক্ষা তো এখন নেই।
সব উঠে গেছে। শুধু পারিবারিকভাবে নয়, শিক্ষার একটা প্রচণ্ড অবনতি ঘটেছে। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তা আমাদের ছেলেমেয়েরা যেসব অপসংস্কৃতি শিখছে, তা বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিটিআরসিকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় জৈবিক ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা আছে।
আমাদের দেশেও আনাচে-কানাচে দু-একটা বেসরকারিভাবে জৈবিক ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা যে নেই, তা না। আছে, কিন্তু অনেকে খবর জানে না, ঠিকানা জানে না। আর এ জন্যই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, এখানে তথ্য-প্রযুক্তির দোষ দিলে হবে না। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে কিছু সুবিধা-অসুবিধা বা পজিটিভ-নেগেটিভ থাকবেই। কোনটি জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, তা তো ঘর থেকে শিখবে।
দু-একটা বিচার হয়েছে বলে যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, তা নয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে দুষ্কৃতকারীরা আশকারা পেয়ে যায়।
মামা-চাচা আছে আমি বেরিয়ে আসব-বিষয়টা এমন। দেশে আইনের শাসন না থাকায় ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।