ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি। ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ১০টি থানা এলাকায় এসব কিশোর অপরাধ দেখা যায় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান।
শনিবার (২৭ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে ‘কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলন নিয়ে ছায়া সংসদ’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, আজকের কিশোর আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে। ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী কেউ অপরাধ করলে আমরা তাকে কিশোর অপরাধী বলছি। এই বয়সী কিশোররা দলবদ্ধভাবে অপরাধ করলে তাকে আমরা বলছি ‘কিশোর গ্যাং’।
কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম করে থাকে পুলিশ। মসজিদে জুমার দিনে ওসিরা কিশোর গ্যাং বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। কিশোর গ্যাং অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশের বিভিন্ন সভা-সমাবেশও করা হয়েছে। স্কুলে-স্কুলে গিয়েও কিশোর গ্যাং অপরাধ প্রতিরোধে বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কিশোর গ্যাং অপরাধ প্রতিরোধে আসল কাজ হবে পরিবার থেকে। পরিবার থেকে মা, বাবা বড় ভাই-বোন এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে।
মোবাইলের দুটি দিক উল্লেখ করে হাবিবুর রহমান বলেন, একটি নেতিবাচক অন্যটি ইতিবাচক। একটি মোবাইল একটি লাইব্রেরি, একটি জ্ঞান ভাণ্ডার। মোবাইলের পজিটিভ দিক শিক্ষার্থীরা যেন ব্যবহার করে সেই শিক্ষাটা অভিভাবকদের দিতে হবে।
খেলাধুলার জায়গার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে খেলার মাঠের সংখ্যা কম। মাঠ নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো খেলাধুলার মাঠের বিষয়ে কাজ করতে পারে।
কিশোর গ্যাংয়ের গড ফাদারদের তালিকা করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে কি-না জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, যারা কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা যারা রয়েছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রয়েছে তাদের তালিকা করা হয়েছে। যারা মদদদাতা গড ফাদার তারা ওইভাবে গড ফাদার নয়। তারা যে কিশোর অপরাধের জন্য গ্যাং তৈরি করেছে বিষয়টি এমন নয়। রাজনৈতিকভাবে কিছু লোক কিশোরদের নিয়ে যাচ্ছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
টিকটকে অশ্লীল কন্টেন্টের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি অবশ্যই নেতিবাচক। ইতোমধ্যে এমন টিকটকারদের আমাদের সাইবার টিম আইনের আওতায় এনেছে। পুলিশের সাইবার টিম বিটিআরসির কাছে বিভিন্ন কনটেন্টের তালিকা দেওয়া হয় নিয়মিত।
কিশোর অপরাধ নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি আছে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো গাফিলতি নেই। অভিযোগ এলেই সঙ্গে সঙ্গে মামলা গ্রহণ করা হয় এবং জড়িতদের আইনের আওতায় এনে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরে কিশোর সংশোধানারে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু প্রাথমিকভাবে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে পুলিশের কাজ নয়। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় জনসাধারণের কাজ। জনগণ সোচ্চার হলে কিশোর গ্যাং কালচার কমে যাবে।
কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত কাউন্সিলদের নাম এসেছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাউন্সিলদের কিছু অনুসারী রয়েছে যাদের ১৮ বছরের উপরে বয়স। এলাকায় রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে কেউ কেউ কিশোরদের ব্যবহার করছে। সরাসরি কোনো কাউন্সিল কিশোরদের নিয়ে অপরাধ করার জন্য গ্যাং তৈরি করেছে এমন তথ্য পাইনি আমরা। কাউন্সিলদের সহযোগী রয়েছেন এমন কেউ কেউ আছেন তারা কিশোরদের নিয়ে চলাচল করেন। এসব কিশোরদের বেশিরভাগই ছিন্নমূল, যারা রাস্তায় কাজ করেন। বেশিরভাগ কিশোরদের বাবা নেই। মা থাকলেও দেখা যায় অন্যের বাসায় কাজ করেন। এসব বিষয়েও পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে আইনের আওতায় পড়লে পুলিশ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক উপনেতা-পাতিনেতাদের বিভিন্ন সময় থানায় ডেকে শাসানোও হচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতরা বেশিরভাগই অপরাজনীতির শিকার। অভিযোগ রয়েছে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা ও ‘বড় ভাই’রা শিশু—কিশোরদের তাদের অনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার করছে। অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থে অর্থের বিনিময়ে অপরাধ করাচ্ছে। জমিজমা, ঘরবাড়ি দখল করাচ্ছে। আবার পুলিশ আটক করলে তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনছে, প্রয়োজনে জামিনের ব্যবস্থাও করছে। ফলে এসব শিশু কিশোররা কিশোর গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত হয়ে বড় ভাইদের পক্ষে ভাড়ায় খাটছে। বড়ভাই নামধারী এসব প্রভাবশালীরা যাতে শিশু কিশোরদের চাঁদাবাজি, মিছিল—মিটিং, দখলবাজি, দলবাজিতে ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনভাবেই কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সুশাসনের অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিও কিশোর গ্যাং কালচার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সর্বস্তরে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ভয়েস রেইস করতে হবে।
জনাব কিরণ আরো বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যের মদদদাতাদের তালিকা করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কোন চাপ থাকলে প্রয়োজনে প্রশ্রয়দাতাদের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রেরণ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরী। প্রয়োজনে কিশোর গ্যাংয়ের আশ্রয় প্রশ্রয় দাতাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে এসব বড়ভাইদের মুখোশ উন্মোচন করা উচিৎ। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা স্বউদ্যোগে কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতদের সম্ভাব্য তালিকা তৈরি করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে কিশোর গ্যাং নিমূর্লে সহযোগিতা করতে হবে। আমি প্রশ্ন রাখতে চাই, সরকারের এতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন তৎপর থাকার পরও কেন আমাদের কিশোর গ্যাং নিয়ে আতংকিত থাকতে হয় ? তবে আশার দিক হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে কিশোর গ্যাং মোকাবেলায় স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। যা কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে ত্রুটিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি, মাদকের সহজলভ্যতা, দারিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, সুশাসনের ঘাটতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ নানা কারণে শিশু কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির প্রবণতাকে আরো বেশি উস্কে দিচ্ছে। বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, লাইকি, ইমুসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিশোর অপরাধের মাত্রাকে ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে কিশোর গ্যাং কালচার তৈরি হচ্ছে।
কিশোর তরুণদের জন্য বর্তমানে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওয়েব সিরিজ। কিছু কিছু অনলাইন প্লাটফর্মে তুমুল অশ্লীলতা, নোংড়া সংলাপ দিয়ে ওয়েব সিরিজ প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব ওয়েব সিরিজগুলো সহজেই কিশোর—কিশোরীদের আসক্ত করে ফেলছে। বিটিআরসিকে এই ধরণের বিতর্কিত ওয়েব সিরিজগুলো সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে “কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার চেয়ে সামাজিক আন্দোলনই অধিক কার্যকর” শীর্ষক ছায়া সংসদে প্রস্তাবের পক্ষে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে ঢাকা কমার্স কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, সাংবাদিক জি এম তসলিম, সাংবাদিক জিয়া খান, সাংবাদিক অনিমেষ কর, সাংবাদিক কাওসার সোহেলী। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।