এক সময় পদ্মা নদীর ফরিদপুরের চরাঞ্চলকে ভাবা হতো অভিশপ্ত। হতোনা তেমন কোনো ফসল, তাই শত শত একর জমিন পড়ে থাকতো অনাবাদি। বছরের কয়েক মাস পানি থেকে জেগে থাকার পর এই চরের জমিনগুলো ফের নিমজ্জিত হয় পদ্মার পানিতে। তাই ওই সময়ে এসব জমিন জুড়ে জন্ম নিতো আগাছা আর ঘাসপাতা। চরবাসী জানান, চরের মানুষের জীবিকা পশু- তথা গরু, ছাগল ও ভেড়া পালন। প্রকৃতিগতভাবে জন্ম নেয়া আগাছা আর ঘাসের উপর ভর করেই পশু পালনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠের তারা। তবে বেশ কিছু বছর আগে পশুর খাবারের চাহিদা মেটাতেই কেউ কেউ ভুট্রার চাষাবাদ শুরু করেন। দেড় যুগ আগেও তারা ভুট্রার গাছকে গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করতেন। তবে প্রায় এক দশক আগে ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে চিত্র। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শেষ কয়েক বছরে ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে ভুট্রার আবাদ। গত রবি মৌসুমে ছয় হাজার হেক্টরের উপরে জমিতে ভুট্রার আবাদ হয়। যা থেকে প্রায় ৬৫ হাজার মেট্রিকটন ভুট্রা উৎপাদন হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় দুইশ কোটি টাকা। এই আবাদের অধিকাংশই পদ্মা নদীর চরাঞ্চল কেন্দ্রিক। আর খরিপ-১ মৌসুমে চারশ ৪০ হেক্টর জমিতে ভুট্রা আবাদের লক্ষমাত্রা ধরা হলেও এরই মধ্যে তা দুই হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে গেছে। আবাদ এখনো চলমান রয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় জেলার চরগুলোতে এখন আর আগের মতো বছরের অধিকাংশ সময় পানির নিচে থাকে না। এখন বছরের তিন থেকে চার মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। তাই বছরের সাত থেকে আট মাস পানি না থাকায় এবং কোথাও কোথাও বিশেষ করে উচু এলাকায় বছরের নয় থেকে ১০ মাস পানি না থাকায় জমি ভেদে এখন বছরে দুই থেকে তিন বার ভুট্রার আবাদ করা হয়ে থাকে। এতে জেলায় বাড়ছে ১২০ দিনের ফসল ভুট্রার আবাদ ও উৎপাদন। কৃষকদের দাবী, প্রতি হেক্টরে ১০ টনের অধিক পরিমান ভুট্রা উৎপাদিত হয় এতে লাভবান হচ্ছেন তারা। তারা জানান, কয়েক বছর আগেও ভুট্রা প্রতি মন পাঁচ থেকে ছয়শ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ১২শ থেকে ১৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হেক্টর প্রতি চাষাবাদ খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা হলেও গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকার ভুট্রা উৎপাদন হয়ে থাকে। এতে অন্য ফসলের তুলনায় যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরে ভুট্রার নানাবিধ ব্যবহার বেড়েছে। উচ্চ মূল্যের কর্নফ্লেক্স, শিশুখাদ্য, পশুখাদ্য, আটার সাথে মিশিয়ে দেয়া, উন্নত মানের বিস্কুট, ছাতু ও উচ্চ মূল্যের কর্ণওয়েল তৈরিও হচ্ছে। গম বা চাউলের থেকে ভুট্রা অধিক পুষ্টিগুন সম্পন্ন উল্লেখ করে তারা জানান, ভুট্রার মধ্যে ১২ শতাংশ প্রোটিন, পাঁচ শতাংশ তেল, ভিটামিন এ রয়েছে। এছাড়া চিনির উপস্থিতি কম থাকার পাশাপাশি এই খাদ্য ফাইভার থাকায় মানব দেহের জন্য উপযোগী। কৃষি সম্প্রসারণ অদিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভুট্রা এমন একটি ফসল যার কোনো অংশই ফেলনা নয়। ভুট্রার গোড়ার অংশ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে, উপরের সবাজ অংশ গো খাদ্য আর ভুট্রার ফল মানুষের খাদ্যসহ বিভিন্ন ধরনের পশু পাখির খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। তিনি জানান, ফরিদপুর সদর উপজেলার পদ্মা নদী বেষ্টিত ডিক্রীরচর, নর্থচ্যানেল ও চরমাধব দিয়া ইউনিয়নের বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে আবাদ হয়েছে ভূট্টার। একদিকে রবি মৌসুমের ভুট্রা ঘরে তুলছেন এসব চরের চাষীরা, আবার অনেকে খরিপ মৌসুমের ফসল আবাদে ব্যস্ত রয়েছেন। এই কৃষিবিদ আরো জানান, চরে বিপুল পরিমান জমি এখনো অনাবাদি রয়েছে। এসব চরের কৃষকদের ভুট্রা আবাদে আগ্রহী করে তুলতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের প্রেষনা দেয়া হচ্ছে। চরের অনাবাদি জমির একটি বড় অংশকে ভুট্রা চাষের আওতায় আনা গেলে বারো মাসি এই ফসলটি থেকে চরবাসী যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবেন, তেমনি খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। এদিকে চরের মানুষেরা জানান, তারা এক সময় ভুট্রার আবাদকে গুরুত্ব দিতেন না, তবে সম্প্রতিকালে ভুট্রার ব্যবহার ও চাহিদা বেড়ে যাওয়ার সাথে মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই আবাদ করছেন ভুট্রার। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীও হচ্ছেন তারা। এতে তাদের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। যদিও এসব চরের ভুট্রাচাষীরা অভিযোগ করেন, কিছু কিছু ব্যবসায়ীরা চরে গিয়ে চাষীদের নিকট থকে ভুট্রা সংগ্রহ করলেও সেই সংখ্যা কম, তাই বাজারজাত করতে এখনো দুরের শহরের নিয়ে আসতে ঝক্কি পোহাতে হয়। তাই চরেই ভুট্রার বাজার সৃষ্টি করা গেলে চরের মানুষের মধ্যে ভুট্রা আবাদের আগ্রহ আরো বেড়ে যাবে। তাতে ঘুরে দাড়াবে চরের মানুষের জীবন মান।