শামুকের তৈরি চুনের গ্রাম হিসেবে খ্যাত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার জুগিপাড়া। জুগি পরিবারদের চুন তৈরির এ ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে জুগি পাড়া নামের ওই গ্রামটি।
বিভিন্ন অভাব-অনটন, পুঁজির অভাব থাকলেও তারা ছেড়ে দেয়নি তাদের বাপ-দাদার পেশা চুন তৈরি। এখনও তারা শামুকের তৈরি জুগি চুনের যোগান দিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধা জেলাসহ উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায়।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে একটু দূরেই বেলকা ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম জুগিপাড়া। শত বছর ধরে বংশ পরস্পরায় ওই গ্রামের বাসিন্দারা শামুকের চুন বা জুগির চুন তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকায় এ গ্রামের নামই হয়ে গেছে জুগিপাড়া।
জুগির চুন তৈরির জন্য প্রধান উপকরণ শামুক। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শামুক-ঝিনুক কিনে এনে এ গ্রামের বাসিন্দারা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার তা রুপান্তর করে পানের খাবার চুনে। আর এ পান তৈরির অন্যতম উপাদান হল চুন।
কিন্তু চুন তৈরির শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। রসনা বিলাসী মানুষের কাছে পান একটি অতি প্রিয় খাবার। সেই পানের স্বাদ যোগায় চুন। জলবায়ূ পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চুন তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত শামুক ও ঝিনুক।
এছাড়া খাল-বিল, পুকুর মাঠ, নদী-নালায় মৎস্য ও ধান উৎপাদনের জন্য প্রচুর পরিমানে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে শামুক-ঝিনুক কমে যাচ্ছে। শামুক-ঝিনুকের খোল দিয়ে তৈরি চুনের কদর আছে ক্রেতাদের কাছে।
তবে চুন তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়লেও এ থেকে তৈরি চুনের দাম বাড়েনি। ফলে লোকসানের মুখে পড়ে চুন তৈরির পেশা ছাড়ছেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।
কীভাবে চুন তৈরি হয় তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই। এর প্রধান উপাদান হল শামুক ও ঝিনুক। প্রথমে ভাটায় (শামুক ও ঝিনুক পোড়ানোর বিশেষ চুলা) কাঠের টুকরা, শামুক ও ঝিনুক পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়।
এভাবে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পোড়ানোর পর সেগুলো পুড়ে সাদা রং ধারণ করে। পোড়া শামুক ও ঝিনুকগুলো ভাটা থেকে নামিয়ে চালুনি দিয়ে চেলে নিতে হয়। এরপর চেলে নেয়া ভালো শামুক ও ঝিনুকগুলো গুড়ো করে মাটির চাড়িতে পানির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়।
বাঁশ বা কাঁঠের হাতা দিয়ে ১ থেকে ২ ঘন্টা ঘুটলে চুনের সাদা রং বেড়িয়ে আসে। তৈরি হয় পান খাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান চুন। এভাবে ৫০ কেজি পোড়ানো গুড়ো শামুক ও ঝিনুকের সঙ্গে পানি মিশিয়ে তা থেকে প্রায় ১৫০ থেকে ১৮০ কেজি চুন পাওয়া যায়।
ধবধবে সাদা করতে চুনের সঙ্গে বিচিকলার রস মেশাতে হয়। এরপর তা জালের মাধ্যমে ছেঁকে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রয়ের উপযোগী করা হয়।
গাইবান্ধার আঞ্চলিক ভাষায় এই চুন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের জুগী বা চুনে বলা হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসহ ৫ উপজেলাতেই এই চুন শিল্পীরা বাস করে। তাদের পূর্ব-পুরুষের ঐতিহ্যগত চুন তৈরির ব্যবসার সঙ্গে এখনও অনেকে জড়িত আছেন।
তবে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে তাদের উপার্জন না বাড়ায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ চুন তৈরির উপাদান না পাওয়ার কারণে অনেকেই পেশা বদল করছেন।
চুল শিল্পের কারিগর আব্দুল আজিজ বলেন, ‘চুন তৈরির কাজ আমাদের জাত পেশা। কিন্তু বর্তমানে খাল-বিল, নদী-নালায় পর্যাপ্ত পরিমাণ শামুক ও ঝিনুক না পাওয়ায় অতিরিক্ত দামে তা সংগ্রহণ করতে হচ্ছে।
অতীতে বস্তাপ্রতি শামুক ও ঝিনুক ৬০ টাকা দরে কিনলেও বর্তমানে প্রতি মণ শামুক ও ঝিনুকের গুঁড়ো ১৮০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। চুনের বর্তমান বাজার দর প্রতি মণ (৪০ কেজি) ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। কিন্তু চুন তৈরিসহ বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে যে লাভ হয় তাতে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই ক্ষতি সামলাতে অনেকে এ পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।
তিনি সংশয় প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘আমি আর কতদিন এ পেশা ধরে রাখতে পারবো তা আল্লাহ তায়ালা জানেন। তাই ছেলে-মেয়েদের অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছি।
উপজেলার বেলকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ বলেন, সুন্দরগঞ্জে যেসব প্রাচীন পেশা রয়েছে, তার মধ্যে জুগীরা অন্যতম। তবে এখন এ শিল্প হারাতে বসেছে।