চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে নিজেই ব্যবসা করছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের (পিডিবিএফ) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলাম-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগে আর্থিক সুবিধা নেয়াসহ নানা অনিয়ম করেছেন তিনি।
এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব) খালিদ পারভেজ খানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি পিডিবিএফের সব প্রকল্প স্থগিত করেছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এর আগে দুর্নীতির কারণে পিডিবিএফের যুগ্ম পরিচালক ড. মনারুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তিনি একাই তিনটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। প্রকল্পগুলো হল- পিডিবিএফ সম্প্রসারণ, আইসিটি ও ই-সেবা শক্তিশালীকরণ এবং গঙ্গাচড়া ও হাতিবান্ধা উপজেলার প্রত্যন্ত এবং চরাঞ্চলে সোলার স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ মন্ত্রণালয়ের বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সব কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তার অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া মনারুলের আর্থিক দুর্নীতির বিষয় খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)।
উল্লিখিত বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব মো. রেজাউল আহসান। তিনি বলেন, ‘পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সব প্রকল্প স্থগিত করা হয়েছে। তারা নতুন করে ৩টি প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
এসব তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি নতুন প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ ড. মনারুল ইসলামের আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন এখনও বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট দেয়নি বলেও জানান সচিব রেজাউল আহসান।
পিডিবিএফ প্রবিধান ও সরকারি কর্মচারী আইন অনুযায়ী, সরকারি কোনো কর্মচারী পূর্বানুমোদন ছাড়া অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না। একই সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো কর্মকর্তা ব্যবসায়ও জড়াতে পারেন না। কিন্তু বিধিবিধান অমান্য করে ক্রয় কমিটির প্রধানের দায়িত্বে থেকেও পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি আমিনুল ইসলাম নির্বিঘ্নে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিন বছরের বেশি সময় ধরে।
২৫ আগস্ট পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দেন প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মী। উল্লেখযোগ্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- সৌরশক্তি উন্নয়ন কর্মসূচির ৮ কোটি টাকার কাজ সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নামে এনজিরা সোলার ও সানার্জি টেকনোলজি লিমিটেডের মাধ্যমে বাজারদরের দ্বিগুণ দামে উপকরণ কিনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠান হলেও এনজিরা সোলারের সঙ্গে আমিনুল ইসলামের স্ত্রী এবং সানার্জি টেকনোলজির সঙ্গে সরাসরি ব্যবসায়িক পার্টনার রয়েছেন এমডি আমিনুল ইসলাম।
সানার্জি টেকনোলজির ১৫ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৫ হাজার শেয়ারের মালিক আমিনুল। তিনি পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব প্রকল্প ‘সৌরশক্তি উন্নয়ন কর্মসূচি’র সিংহভাগ কাজ পায় (২ কোটি টাকা) সানার্জি টেকনোলজি। অভিযোগ অনুযায়ী, আমিনুল পিডিবিএফে তার অধীন প্রকল্পে নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে তিনগুণ দামে পণ্য কিনছেন।
বাজারে যে সোলার ১২ হাজার টাকা, সেই সোলার কেনা হয়েছে ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার টাকায়। এভাবে আমিনুল পিডিবিএফের প্রধান হয়েও আলাদা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে ২ প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন, যা পিডিবিএফ প্রবিধানমালার ৪নং অনুচ্ছেদ-৩-এর (ক) এবং (খ)-এর পরিপন্থী। এ দুটি ধারায় বলা হয়েছে, (ক) ফাউন্ডেশনে তার কর্মকালীন সময়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্য কোথাও কোনো পদে অথবা অন্য কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক কোন কাজ করিবেন না। (খ) ফাউন্ডেশনের ব্যবসার বা কাজ-কারবারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নিকট থেকে কোনরূপ উপহার সামগ্রী গ্রহণ করা যাইবে না।
এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ ও সাজাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উচ্চতর পদে পদায়ন এবং ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের কথা উল্লেখ করা হয় ওই অভিযোগপত্রে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে খতিয়ে দেখতে ২৩ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি গঠন করে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ।
সানার্জি টেকনোলজির ৫ হাজার শেয়ার কেনার কথা স্বীকার করলেও বাকি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী এনজিরা সোলার কোম্পানির কোনো সাইনিং অথরিটি নন। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি নেই। আমি ইতোমধ্যে সানার্জি টেকনোলজির শেয়ার সারেন্ডার করেছি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে।
একজন নাগরিক হিসেবে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনতে পারি। এতে পিডিবিএফের প্রবিধানমালার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।’ আর্থিক সুবিধা নিয়ে কাউকে নিয়োগ বা উচ্চপদে পদায়ন করেননি বলেও মন্তব্য করেন আমিনুল ইসলাম।
অভ্যন্তরীণ পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পিডিবিএফের ভারপ্রাপ্ত এমডি আমিনুলের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প ‘হাজামজা বা পতিত পুকুর পুনঃখননের মাধ্যমে সংগঠিত জনগোষ্ঠীর পাট পচানো-পরবর্তী মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা লোপাটের প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে তার বিরুদ্ধে।
এতে বলা হয়, মূল কাজ পুকুর পুনঃখনন না করে ২৯ গাড়ি ও মোটরসাইকেল কেনাসহ অন্য কার্যক্রম ব্যস্ত ছিলেন কর্মকর্তারা। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং লক্ষ্য থেকে ৩৬ শতাংশ পিছিয়ে পড়ে।