হয়রানিসহ নানা কারণে হিমাগারে আলু সংরক্ষণে আগ্রহ নেই ব্যবসায়ীদের। এদিকে ভালো দাম পাওয়ায় এবং হিমাগার ভাড়া বৃদ্ধির শঙ্কায় ক্ষেতেই আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন চাষিরা। এভাবে বিক্রি হয়ে গেলে রংপুরে হিমাগারে রাখার আলু মিলবে না। এতে এ বছর আলুর ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে এবং এবার আরও বেশি দামে ভোক্তাদের আলু কিনে খেতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন হিমাগার মালিকরা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ বছর ১ লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। এর মধ্যে তিস্তার চরাঞ্চলসহ রংপুর জেলাতেই আলু চাষ হয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ১১ হাজার ৩৫৪ টন। তবে আশানুরূপ দাম ও চাহিদা থাকায় অনেক চাষি পরিপক্ব হওয়ার আগে ক্ষেতেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে আলু উত্তোলনের ভরা মৌসুম। ইতোমধ্যে ৫০ ভাগ জমির আলু উত্তোলন হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
রংপুর জেলায় ৩৯টি হিমাগারে আলুর ধারণক্ষমতা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৮ টন। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে আলু সংরক্ষণ শুরু হলেও তা আশানুরূপ নয়। ৩৯টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণের সঠিক অঙ্ক বলতে না পারলেও হিমাগার ব্যবসায়ীরা বলছেন, অন্যান্য বছর মার্চের প্রথম সপ্তাহে যে পরিমাণ আলু সংরক্ষণ হয়েছিল, একই সময়ে এ বছর তার অর্ধেক আলু সংরক্ষণ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, গত বছর বেশি আলু সংরক্ষণ বা মজুতের অভিযোগে অনেক ব্যবসায়ীর জেল-জরিমানা হয়েছে। সে কারণে তারা এ বছর আলু সংরক্ষণের সাহস পাচ্ছেন না। এ ছাড়া ভালো দাম ও চাহিদা থাকায় হিমাগার ভাড়াসহ ঝক্কি এড়াতে চাষিরা ক্ষেতেই আলু বিক্রি করে দিচ্ছেন। এনএন হিমাগারের ব্যবস্থাপক দুলাল হোসেন বলেন, ‘অন্যান্য বছর চাষিরা আলু রাখার জন্য ধরনা দিতেন। কিন্তু এ বছর আলু সংরক্ষণে চাষিদের পেছনে ছুটতে হচ্ছে।’ হিমাগারে সংরক্ষণে গত বছর প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) আলুর ভাড়া ৩০০ টাকা ছিল। চলতি বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ার শঙ্কায় এখনও ভাড়া নির্ধারণ হয়নি। তবে এ বছর ভাড়া বাড়তে পারে বলে জানান হিমাগার মালিকরা।
তিস্তার চরাঞ্চল রংপুরের মহিপুর, পূর্ব ইছলী, ছালাপাকসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আলু উত্তোলনের ধুম পড়েছে। নারী-পুরুষ মিলে ক্ষেত থেকে আলু তুলছেন। ক্ষেতেই আছেন ক্রেতারা (পাইকার)। ওই আলু বস্তায় ভরে ট্রাকে করে পাঠাবেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মহিপুর এলাকার আবদুল আউয়াল এক একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। ২৩ টাকা কেজি দরে সব আলু স্থানীয় পাইকারের কাছে বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, এ বছর বীজ, সার, কীটনাশক কেনাসহ আলু উৎপাদনে দেড় গুণ বেশি খরচ হয়েছে। গত বছরের মতো শেষ দিকে যদি আলুর কেজি ১০ টাকায় নামে, তাহলে অনেক বেশি লোকসান গুনতে হবে। হিমাগারে সংরক্ষণেও গুনতে হবে বাড়তি খরচ। ভালো দাম ও চাহিদা থাকায় ক্ষেতেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন।
তিস্তার চরের সোনা মিয়া, আলী হোসেনসহ অনেকেই এক সপ্তাহ আগে ২২ থেকে ২৩ টাকা কেজি দরে কার্ডিনাল জাতের আলু ক্ষেতেই বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা জানান, ভরা মৌসুমেও আলুর দাম ও চাহিদা দুটোই আছে। এতে হিমাগারে রাখার বাড়তি খরচসহ ঝক্কি-ঝামেলা নেই।
নানা কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ বছর আলু সংরক্ষণে অনীহা দেখা দিয়েছে। তারা জানান, মৌসুমে চাষি পর্যায়ে আলু কিনে প্রতিবছর হিমাগারে সংরক্ষণ করা হয়, যা বছরজুড়ে বাজারগুলোতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু গত বছর বেশি আলু সংরক্ষণের দায়ে অনেক ব্যবসায়ীর জেল-জরিমানা হয়েছে। রংপুর জেলা আলু ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সত্যজিত কুমার বলেন, ‘বেশি আলু সংরক্ষণের কারণে আমাকে জেল খাটতে হয়েছে। সে কারণে এ বছর আগ্রহ নেই। আলু সংরক্ষণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার।’
রংপুর হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোছদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, সংকটকালে এ অঞ্চলে আগাম উৎপাদিত আলু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। ভরা মৌসুমে আলু সংরক্ষণ হয় হিমাগারে। কিন্তু চলতি বছর চাহিদার কারণে আগাম ও অপরিপক্ব আলু ক্ষেতেই বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ভরা মৌসুমে আলুর ওপর চাপ পড়েছে। এ বছর হিমাগারগুলো খালি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থা হলে বছরজুড়ে আলুর মহাসংকট থাকবে।