গত কয়েক দিন ধরে উত্তরের জেলাগুলোতে তীব্র শীত জেঁকে বসেছে। এর প্রভাব পড়েছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। এ অবস্থায় নীলফামারী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে আসন সংখ্যার দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে ভিড় করছেন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষজন। তাদের মধ্যে ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগী বেশি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রংপুর, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় দিনের বেশিরভাগ সময় সূর্যের দেখা মেলে না। সন্ধ্যার পর থেকে বাড়তে থাকে হিমেল হাওয়া। রাতে ঘন কুয়াশার সাদা চাদরে ঢেকে যায় চারদিক। দুপুর পর্যন্ত কুয়াশার কারণে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হয়। দুপুরের পরও সূর্য দেখা যায় না। শীত জেঁকে বসায় কষ্ট বেড়েছে ছিন্নমূল মানুষের। গত কয়েক দিন ধরে শীতের তীব্রতায় জবুথবু জনজীবন। কনকনে শীতে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ।
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, ডায়রিয়া, নবজাতক ও শিশু ওয়ার্ডে মিলছে না রোগীর ঠাঁই। প্রতিদিনই চিকিৎসা নিতে ভিড় করছেন শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষজন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২৭৮ জন। তবে ডায়রিয়া, শিশু ও নবজাতক ওয়ার্ডে রোগীর চাপ অনেক বেশি। প্রতিদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় এক হাজার রোগী। আন্তঃবিভাগে ভর্তি রোগীর মধ্যে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা বেশি।
সোমবার দুপুরে হাসপাতালের ডায়রিয়া, শিশু ও নবজাতক ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন রোগীরা। ২৫ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডটিতে বিভিন্ন বয়সের ৩১ জন, শিশু ওয়ার্ডে ১০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি আছে ৪০ জন ও নবজাতক ১০ শয্যার বিপরীতে চিকিৎসা নিচ্ছে ১৮ জন। শয্যা সংকটের কারণে এক বিছানায় দুই থেকে তিন শিশু রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকের ঠাঁই মিলছে বারান্দায়। কেউ কেউ চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
শিশু ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বিছানায় আট মাস বয়সী তাসনিমকে নিয়ে অবস্থান করা মা আলেয়া বেগম বলেন, ‘গত শুক্রবার তাসনিমের সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি করি। কিন্তু বিছানা সংকটের কারণে এক বিছানায় দুজনকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এছাড়া বাথরুম, টয়লেট ও পানির সংকট একটি বড় সমস্যা। অনেক কষ্টে হাসপাতালে আছি।’
একই ওয়ার্ডের কর্তব্যরত নার্স মিরা রানী রায় বলেন, ‘প্রত্যেক বছর শীতে এসব ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। বিশেষ করে নবজাতক ও শিশুরা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। তাদের সেবা দিতে আমাদের অনেক সময় হিমশিম খেতে হয়। তারপরও আমরা সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
গত শুক্রবার বিকালে ছয় মাস বয়সী রহমতুল্যাকে নিয়ে নবজাতক ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন মা সোনালী বেগম। তিনি বলেন, ‘জ্বর, সর্দি, কাশি ও বুকে ব্যথা নিয়ে ছেলেটাকে ভর্তি করেছি। কিন্তু এখানে এক বিছানায় দুজন আছি আমরা। ঘুমাতে পারি না, বসতে পারি না। সারারাত জেগে থাকতে হয়।’
শীতে শিশুরা ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘এক্ষেত্রে চিকিৎসকের চেয়ে মায়ের ভূমিকা বেশি। শিশুদের গরম কাপড়, গরম খাবারের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
তীব্র শীতের কারণে নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি ও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে উল্লেখ করে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. গোলাম রসুল রাখি বলেন, ‘শীতের কারণে নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। পাশাপাশি যাদের হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে তাদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন শিশু ও বৃদ্ধরা। এই জাতীয় রোগ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’
শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবু আল হাজ্জাজ বলেন, ‘শীতে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রচুর সরকারি ওষুধ বরাদ্দ আছে। শীতজনিত রোগ দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।’
সৈয়দপুর বিমানবন্দর আবহাওয়া কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হাকিম বলেন, ‘সোমবার জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। জেলায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী এক সপ্তাহ এই আবহাওয়া চলমান থাকতে পারে।’
ডিমলা আবহাওয়া অফিসের সহকারী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘সীমান্তঘেঁষা ডিমলা উপজেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বোচ্চ ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তর থেকে বয়ে আসা হিমেল হাওয়া জেলার মানুষকে কাবু করে ফেলেছে। আগামী কয়েকদিন এই আবহাওয়া থাকতে পারে।’