দেশ যখন বিস্ময়কর সম্ভাবনা নিয়ে নতুন সহস্রাব্দে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম ও সমাজের অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্কে ক্রিয়াশীল ‘অনলাইন জুয়া’। এ কারণে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। যুবসমাজের সামনে এখন কোনো স্বপ্ন নেই, আদর্শ নেই; আছে হতাশা, আছে ক্রোধ। হতাশা, উচ্চাভিলাষ, সামাজিক অস্থিরতা এবং দুঃখবোধ থেকে সাময়িক স্বস্তি লাভের আশা থেকেই এ উৎকট অনলাইন জুয়ার নেশা ক্রমবিস্তার লাভ করছে সমাজে। স্কুল-কলেজের ছাত্র থেকে শুরু করে ভ্যান চালক পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার যুবকরা কাজ-কর্ম ফেলে ডুবে আছে জুয়ায়। এখন কাজ নয়, বরং অল্প সময়ে সাবলম্বী হওয়ার দিবাস্বপ্নে খানিকটা যেন বুদ হয়ে পড়েছে তারা। এ ক্ষেত্রে শুধু টাকা হলেই চলবে। যদিও হাতে গোনা দু’একজন ছাড়া অধিকাংশরাই সর্বশান্ত হয়ে পড়েছে। তারপর শুরু হয় ঋণ, সে চড়া সুদের ঋণে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন আত্মহত্যায়। তরুণ প্রজন্ম স্মার্টফোনের দৌলতে মেতে উঠেছে সর্বনাশা অনলাইন জুয়ায়। অভিভাবকরা ভুগছেন দুশ্চিন্তায়। দ্রুত নেমে যাচ্ছে শিক্ষার মান। সমাজজীবনে সুস্থ বিনোদনের অভাব ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। মানুষ সহজেই এই নেশার কবলে পড়ছে। অনলাইন জুয়ার নেশায় বাইরের জগতের সৌন্দর্য তাদের কাছে অর্থহীন ও নিরানন্দময়। আড্ডার ছলে হয় শুরু, লোভ থেকে নেশা, সেখান থেকে নিঃস্ব। জুয়ার কালো দুনিয়ার ভয়ংকর সব ফাঁদ পাতা অফলাইন আর অনলাইনে। যেখানে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত লাখো পরিবার। ফিরে আসার পথ যেন পেন্ডুলাম বক্স! জুয়ার অন্ধকার জগতে কীভাবে ঝুঁকছে তরুণরা? জানতে কথা হয় আসক্ত এক তরুণের সঙ্গে। পরিচয় গোপন করার শর্তে সেই যুবক জানিয়েছেন কালো দুনিয়ার কার্যক্রম। তার ভাষ্য, দুই দিন কাজ করলে যে টাকা আসে তা বাজি ধরলে এক সেকেন্ডেই চলে আসে। এ জন্য এর প্রতি লোভও তৈরি হয়। অনেকে এভাবে জুয়ায় জড়িয়ে যায়। প্রথম দিকে লাভ হলেও শেষ দিকে লোকসান হয়। আইপিএল, পিএসএল, বিগ ব্যাশ, ফুটবল লিগগুলো ঘিরেই খেলায় মাতেন জুয়াড়িরা। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, অনলাইন জুয়াতে এসেছে ভিন্নতা। গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দেশীয় বেটিং সাইট। মোবাইলে বিভিন্ন মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ক্ষুদে বার্তা দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে জুয়া খেলায়। আসক্ত সেই যুবক বলেন, পাড়া-মহল্লায় কয়েকজন একত্রিত হয়েও বাজি খেলে। দেখা গেল আমি মুম্বাই নিলাম, আরেকজন দিল্লি নিল। এসব ম্যাচে এক হাজার থেকে শুরু করে লাখের বেশি টাকাও বাজি ধরা হয়। অনলাইন-অফলাইনের বাইরে আরও বেশ কিছু নতুন মাধ্যম খুঁজে নিচ্ছে জুয়াড়িরা। দেশের ভেতরেও গড়ে উঠছে নতুন নতুন জুয়ার সিন্ডিকেট। যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। ফলে সহজেই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বাইরের দেশে। এসব জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন ফেসবুক এবং ইউটিউব চ্যানেলগুলোতেও প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউটিউবে সম্প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকে এমনই অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচার করায় বাংলাদেশের জনপ্রিয় এক ইউটিউবার এবং তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সঙ্গে ভারতীয় এক জুয়ার এজেন্টের গত তিন বছর ধরে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, অভিযুক্তরা তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের এক ওয়েব সিরিজে নিয়মিত বিজ্ঞাপন প্রচার করে আসছে। প্রতি পর্বে একেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য ওই ভারতীয় এজেন্টের থেকে অভিযুক্তরা ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত চার্জ করতো বলে জানিয়েছে পুলিশ। ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিট জানায়, তারা এসব সাইট নিয়মিত নজরদারিতে রাখছে এবং একাধিক সাইট ব্লক করার জন্য বিটিআরসির কাছে নিয়মিত রিপোর্ট করা হচ্ছে। সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে অনলাইন জুয়ার ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। গুগল প্লে স্টোর থেকে জুয়া বিষয়ক অ্যাপ বন্ধের জন্য গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে রিপোর্ট করেছে বিটিআরসি। এরি মধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যাপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, বাকিগুলো যাচাই বাছাই করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এ আইন ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনও ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনও সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম কোনও ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যেকোনো সরঞ্জামসহ কোনও ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০০ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, জুয়ার চক্রটি শুধু তাদের নিজের স্বার্থে অপরাধ করছে বিষয়টি এমন নয়। এখানে যে আয় হয় সেটার ভাগিদার অনেকেই। এ কারণে সমস্যাটা সমাধান করা যাচ্ছে না। বাইরের সাইটগুলো সঠিকভাবে জুয়ার পেমেন্ট করে থাকে। বাংলাদেশে কিছু প্রতিষ্ঠিত সাইট আছে তারা কিন্তু জুয়ার পেমেন্টগুলো করে না। লোকাল লোকদের বসিয়ে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করে একটা সুনির্দিষ্ট সময়ের পর তারা প্রাপ্তটা পায় না। অথবা তারা হারিয়ে ফেলে। প্রতিনিয়ত এসবের বিরুদ্ধে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। এরপরও ঘটছে জুয়ার বিস্তৃতি। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জাতীয় জুয়ার সাইটগুলো নির্ণয় করার জন্য ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স খুব প্রয়োজন। ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপ-কমিশনার তারেক বিন রশিদ জানান, অনলাইনে জুয়ারিদের একটি চক্র দেশের বাইরে থেকে এসব অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেইসাথে অনলাইনে অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারণ এসব বেটিং অ্যাপ, ওয়েবসাইট বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। তাই এসব টাকা কোন না কোন ভাবে বিভিন্ন হাত ঘুরে দেশের বাইরেই যায়।