প্রায় পানিশূন্য তিস্তা এখন হুমকির মুখে। প্রতিবছর নদীর বুক চিরে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন চরাঞ্চলের। পানিশূন্য তিস্তায় দৃশ্যমান ধূ ধূ বালুচর। এক সময় পানির কলকলানীতে নদীর চারপাশ মুখরিত থাকলেও বর্তমানে যৌবন হারিয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ এই নদীটি। নদীর জেগে ওঠা চরের এক পাশ দিয়ে ছোট নালা আকারে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। চর-দ্বীপচরের প্রতিটি বালুকণায় মিশে আছে হাজারো মানুষের হাড়ভাঙা শ্রম। যাদের শ্রমে-ঘামে কমলা-হলুদ সোনায় ভরে উঠে বিস্তীর্ণ বালুচর। গবাদি পশুর একটা বড় অংশই আসে চরাঞ্চলের গতরখাটা মানুষের গোয়াল থেকে। অথচ এ জনপদে জীবন যেন এক একটা দুর্বিষহ গল্পগাথা। বেঁচে থাকা মানেই দুঃখ-কষ্টের পাহাড়।
নদ-নদী শুকিয়ে যখন বিশাল মরু, তখন মাইলকে মাইল পাড়ি দিতে হয় পায়ে হেঁটে। রোগে আক্রান্ত হলেও সুযোগ-সুবিধার অভাবে নিরুপায় সাধারণ মানুষ। কখনো কখনো চিকিৎসকের মুখ দেখার আগেই দেখা হয়ে যায় আজরাইলের সাথে। তিস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার কারণে বেকার হয়ে পড়েছে জেলে ও নৌ-শ্রমিকরা। নাব্যতা সংকটে ৩০ রুটে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। শুকনা মৌসুমে নদীপথ পারি দিতে সীমাহীন কষ্ট করতে হচ্ছে পথচারিদের। যার কারণে হাজারও নৌ-শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেঁচে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে নৌ-শ্রমিকরা। পাশাপাশি নাব্যতা সংকটে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। হারিয়ে যেতে বসেছে নদীতে বসবাসরত বিভিন্ন প্রাণীকুল। স্বাধীনতার পর আজও গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদী ড্রেজিং, খনন, সংরক্ষণ ও সংস্কার করা হয়নি। সে কারণে দিনের পর দিন উজান থেকে নেমে আসা পলি জমে খর স্রোতি রাক্ষুসি অগভীর তিস্তা নদী ভরাট হয়ে ধূ-ধূ বালুচর এবং আবাদি জমিতে পরিনত হয়েছে। তিস্তার গতিপথ পরিবর্তন হয়ে অসংখ্য নানা, খাল ও শাখানদীতে রুপ নিয়েছে। শুকনা মৌসুমে নদীপথে চলাচল অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। নদীপথে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে পায়ে হেঁটে, ঘোড়ার গাড়ীতে, বাঁশের সাঁকা, মোটর সাইকেল ও বাইসাইকেল চরে। সে কারণে হাজারও নৌ-শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। নষ্ট হচ্ছে নৌ-শ্রমিকদের উপকরণ নৌকা, জাল, বাঁশের তৈরি মাছ ধরার যন্ত্র। শ্রমিকরা এখন বাপ দাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে রিক্সা, ভ্যান, অটোবাইক চালিয়ে অনেকে রাজমিস্ত্রির ও বিভিন্ন কলকারখানায় দিনমজুরের কাজ করছে। গাইবান্ধার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ মানুষের বসবাস সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের ১৬৫টি চর-দ্বীপচরে। সেখানে অন্তত ৪৭ শতাংশ মানুষেরই জীবনমান দারিদ্র্য সীমার নিচে। বন্যা, নদীভাঙন, শৈত্যপ্রবাহ, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই কেটে যায় এসব মানুষের জীবন। অথচ গত ৩ দশকে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের বেশকিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে এসব চর-দ্বীপচরে বাস্তবায়ন করা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। তবুও উন্নয়ন ধরা দেয়নি এখানকার মানুষের জীবনে। প্রাণিসম্পদ ও কৃষিতে কিছুটা সফলতা এলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নারী উন্নয়ন, মাতৃমৃত্যু রোধ, অপুষ্টি, শিশু বিয়ে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কারিগরি শিক্ষা, তথ্য ও প্রযুক্তিতে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশ পিছিয়ে গাইবান্ধার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের মানুষ। নদীর নাব্যতা সংকটে ভেঙে পড়েছে নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থাও। প্রাথমিক শিক্ষায় কিছুটা অগ্রগতি হলেও বেসরকারি উদ্যোগে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে মোটে চারটি। এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো কলেজ গড়ে না ওঠায় উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত চরের ছেলে-মেয়েরা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী চরাঞ্চলে অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন, অপুষ্টি, বাল্যবিয়ে ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গাইবান্ধা জেলায় সবচেয়ে বেশি। গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, চরাঞ্চলে বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার ২০টিরও বেশি প্রকল্প চলমান রয়েছে। তবে এসব প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে গবেষণা ও নতুনত্ব না থাকায় মানুষের টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে না। এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে চরাঞ্চলে সচেতনতামূলক কাজ হলেও অবকাঠামোগত কাজ তেমন হয়নি। জানা যায়, ১৯৩৮ সালে গাইবান্ধার তিস্তামুখ-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি চলাচল শুরু হলে সময় ও খরচ বাঁচাতে নৌপথে যাতায়াত করত ৮ জেলার মানুষ। পরবর্তীতে নাব্যতা সংকটের কারণে বালাসীতে ঘাট স্থানান্তর করা হলেও একই কারণে ২০০৪ সালে বন্ধ হয় বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌরুটে ফেরি ও লঞ্চ সার্ভিস। গাইবান্ধার ফুলছড়ি অংশে ব্রহ্মপুত্র নদ। চাষাবাদে সহযোগী হলেও পানিশূন্য প্রায় ব্রহ্মপুত্রে চলছে ঘোড়ার গাড়ি। অভ্যন্তরীণ নৌরুট বন্ধ হওয়ার পর পানির অভাবে ঠেলেঠুলে চলছে আন্তঃ জেলা রুটের কয়েকটি নৌকা। যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সংকটাপন্ন কৃষি, জীববৈচিত্র্য আর জীবন-জীবিকা। শুধু ব্রহ্মপুত্র নয়, জেলার নদীগুলোর সবই নাব্যতা হারিয়ে এখন প্রাণহীন। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনাবেষ্টিত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সদর, সাঘাটা এ চার উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতি বছর দেখা দিচ্ছে নদীভাঙন। এ আগ্রাসী ভাঙনে ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব হারানো বাস্তুচ্যুত মানুষ বলেন, নদীভাঙন প্রতি বছরই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নদী কেড়ে নিচ্ছে তাদের সহায়সম্বল। সব হারিয়ে প্রতি বছর নতুন করে নিঃস্ব হচ্ছে নদীপারের মানুষ। আবার বর্ষাও কখনোই বিলাসী কিংবা উপভোগের হয়ে ওঠে না তিস্তা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের কোলে। উজানের ঢল আর ঘূর্ণিপাক সরাসরি আঘাত হানে খেটে খাওয়া মানুষের জঠরে। ফুল-ফল-ফসলের ক্ষেত ভাসিয়ে কেড়ে নেয় মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও। কূল-কিনারা হারিয়ে কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়ায় তারা। জানা যায়, গাইবান্ধায় নদীতীর ও চরাঞ্চলের প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর ছোট-বড় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর নদীভাঙনে বসতভিটা ও জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয় গড়ে অন্তত ৪ হাজার পরিবার। বন্ধ হয়ে গেছে নৌ-পথের ব্যবসা-বাণিজ্য। সদর উপজেলার মীরগঞ্জ, বেলকা, রামডাকুয়া, তারাপুর, হরিপুর, পাঁচপীর, শ্রীপুর, লালচামার ও কাপাসিয়া খেয়াঘাট থেকে পীরগাছার তাম্বুলপুর, তিস্তা সেতু, হারাগাছ, উলিপুর, চিলমারি, কাশিম বাজার, থানার হাট, রৌমারি, ভুরুঙ্গামারি, যাদুরচর, জামালগঞ্জ, বাহাদরাবাদ, দেওয়ানগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে নৌ-চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।