বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলামের ৬২তম মৃত্যুবার্ষিকী । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, রাজনৈতিক সহকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহপাঠি, ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন অন্যতম সদস্য, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত এমএলএ ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট দবিরুল ইসলাম। যাকে নিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ গর্ব করে, দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও বাসি অহংকার করে, তিনি তুখোড় ছাত্রনেতা উত্তরবঙ্গের উজ্জ্বল নক্ষত্র, ঠাকুরগাঁ জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বামুনিয়া গ্রামে অকাল বয়সে ৪ সন্তান এবং স্ত্রীকে বিধবা করে ১৯৬১সালে ১৩ জানুয়ারি এই দিনে মৃত্যু বরন করেন। দবিরুল ইসলাম বৃহত্তর দিনাজপুরের তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার বামুনিয়া গ্রামে ১৯২২ সালে ১৩ মার্চ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রবস্থাতেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখা শুরু করেন। লাহিড়ী এম.ই হাই স্কুল থেকে বিভাগীয় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রাজশাহী বিভাগীয় ‘মায়াদেবী উম্মুক্ত রচনা প্রতিযোগীতায়’ লাভ করেন স্বর্ণ পদক। এরপর ১৯৩৮ সালে ঠাকুরগাঁও থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারী কলেজে। এখান থেকে আই.এ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ পাশের পর আইন বিভাগে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই দিনাজপুরে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তখনই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান দবিরুল ইসলাম। তাই ১৯৪৬ সালে ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে ডাক পড়ে তার। সেই সম্মেলনে দবিরুল ইসলামের সঙ্গে আরও যোগ দেন মুস্তফা-নুর-উল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, আব্দুর রহমান চৌধুরী, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ। সেদিন গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে এক আগুনঝরা বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন ছাত্রনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন তিনি। এরপরে ১৯৪৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম আহবায়ক কমিটি গঠিত হলে আহ্বায়ক হন রাজশাহীর নঈমুদ্দিন আহম্মেদ। নবগঠিত এই কমিটিতে ফরিদপুর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লা থেকে অলি আহাদ এবং দিনাজপুর থেকে দবিরুল ইসলাম সহ মোট ১৪ জন প্রতিনিধি এ কমিটিতে অর্ন্তভূক্ত হন। কমিটির নেতাদের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, মেধা আর পরিশ্রম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়াকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়। চলতে থাকে পাকিস্তান বিরোধী ও রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার দূর্বার আন্দোলন। সারা দেশের মতো দিনাজপুরেও ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের উত্তাপ। তখন দিনাজপুরে দবিরুল ইসলাম, নুরুল হুদা, কাদের বক্স (ছোটি ভাই), এম আর আখতার মুকুলসহ অনেকেই ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন। এরই মাঝে দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (বর্তমানে সরকারি মহিলা কলেজ) এক ছাত্র জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে গ্রেফতার হন দবিরুল ইসলাম। দিনাজপুর জেলখানায় তাকে অমানুষিক নির্যাতন, জুলুম ও মারপিট করা হয়। বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে তার বুকে আঘাত করা হয়। এভাবে ব্যাপক নির্যাতন ও অত্যাচারের কারণে দবিরুলের স্বাস্থ্য চিরতরে ভেঙ্গে যায়। বঙ্গবন্ধু সহ বেশ কয়েকজন নেতা দবিরুল ইসলাম ও অন্যান্য ছাত্রনেতাদের প্রতি এরকম নির্যাতনের খবর শুনে দিনাজপুরে ছুটে যান। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেছেন। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নায্য আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের সঙ্গে আমার বাবা দবিরুল ইসলামও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হন। এ দিকে রাষ্ট্র ভাষা অধিকার বাস্তবায়নের দাবির মধ্যে দিয়ে ১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে দবিরুল ইসলাম ঢাকা জেলখানায় অন্তরীণ থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’সহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সার্বিক সম্মতি ও মতামতের ভিত্তিতে দেশের ইতিহাসে দবিরুল ইসলামকে ছাত্রলীগের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনিই সভাপতি ছিলেন। ছাত্রলীগের কমিটি হওয়ায় কিছুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর রোষানলে পড়েন তিনি। আবার তাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। এরপর আবার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে ঠাকুরগাঁও আসনের জন্য মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটের ব্যাবধানে মুসলিম লীগের তৎকালীন বাঘা নেতা নুরুল হক’কে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন দবিরুল ইসলাম। পরে ১৯৫৪ সালের ৩০ আগষ্ট পাকিস্তান সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দিলে আবারও পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব সারাদেশ জুড়ে তুঙ্গে উঠে। এরই মধ্যে ১৯৫৬ সালে আবু হোসেন সরকার নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন দবিরুল ইসলাম। তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পার্লামেন্টারী সেক্রেটারি (শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম) নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি ঠাকুরগাঁওতে একটি সুগার মিল স্থাপনের জন্য তৎকালীন সরকারের কাছে এর স্বপক্ষে জোরালো দাবি তুলে ধরেন। বারবার কারাভোগ এবং জেলখানার ভিতরে অমানুষিক নির্যাতনের কারণে তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তারপরেও দেশ ও জনগণের মুক্তির জন্য বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে রাজপথে নিজেকে সর্বদা সরব রেখেছিলেন। অবশেষে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনের এ অগ্র সৈনিক, বিরল প্রতিভার অধিকারী মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম ১৯৬১ সালের ১৩ জানুয়ারি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তার নিজ গ্রাম বামুনিয়াতে মৃত্যুবরণ করেন। আমার বাবা মরহুম দবিরুল ইসলামের মৃত্যুর এতটি বছর পার হলেও আজও তাকে রাষ্ট্রীয় ভাবে কোন স্বীকৃতি বা সম্মাননা প্রদান করা হয়নি। মূল্যায়ন করা হয়নি বিরল প্রতিভার অধিকারী এ রাজনীতিবিদকে। মরহুম দবিরুল ইসলামের সন্তান হিসেবে বর্তমান সরকার প্রধানের কাছে আজ আমাদের দাবি রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা সৈনিক হিসেবে আমার বাবাকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামের জন্য তার অসামান্য অবদান ও তার স্মৃতি সংরক্ষনের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে তার মূল্যায়নের জন্য ঠাকুরগাঁও শহর থেকে লাহিড়ীহাট পর্যন্ত সড়কটির নাম ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসলাম সড়ক নামকরণ করা এবং তার নামে ঠাকুরগাঁও জেলায় সরকারিভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। ভাষা সৈনিক দবিরুল ইসমামের আজ ৫৫তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তার প্রতি পরিবার ও ঠাকুরগাঁও জেলার সর্বস্তরের মানুষের পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।