আল্লাহ যদি তোমাকে কোনো অকল্যাণ দিয়ে আক্রান্ত করেন তাহলে তিনি ছাড়া তা দূর করার আর কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমার কোনো কল্যাণ চান তবে তাঁর দয়া প্রতিহত করারও কেউ নেই। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা কল্যাণ দান করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা ইউনুস (১০) : ১০৭
এই ঘোষণা পবিত্র কুরআনের। আর প্রতিটি মুমিন আল্লাহর কালামের প্রতি বিশ্বাসী। এ বিশ্বাস স্হাপন তার ঈমানের অংশ। সঙ্গত কারণেই যে কোনো বিপদে-আপদে মুমিন আল্লাহ তাআলারই শরণাপন্ন হয়। তাঁকেই ডাকে। তাঁর কাছেই দুআ করে। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছেন এভাবে- যখন তুমি কিছু প্রার্থনা করবে তখন আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করবে; যখন সাহায্য চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫১৬
প্রতিটি মুমিনই শাশ্বত এ বাণীতে বিশ্বাস করে। এ বিশ্বাস তার ঈমানের অংশ। কোনো সংকট তৈরি হলেই মুমিন আল্লাহ তাআলার দরবারে দু’হাত তুলে দুআ করতে থাকে। তার বিশ্বাস- আল্লাহ ছাড়া তাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর কেউ নেই, তার প্রয়োজন পূরণ করে দেয়ার মতো অন্য কেউ নেই। সুতরাং আল্লাহর নিকট পৌঁছার তার শেষ ভরসা হলো দো’আ। দো’আ শব্দের শাব্দিক অর্থ ’হলাে ডাকা, আহ্বান করা ও প্রার্থনা করা। পরিভাষায়, আল্লাহর নিকট বিনয়ের সাথে কিছু প্রার্থনা করাকে দো’আ বলা হয়। কখনাে যিকিরকেও দো’আ বলা হয়। আল্লাহর কাছে দো’আ খুবই প্রিয়। তাই তিনি বান্দাকে দো’আ করতে আদেশ দেন এবং তা কবুল করারও প্রতিশ্রুতি দেন। ইতিপূর্বে আল্লাহ তায়ালা কেবল নবী-রাসূলগণকেই দো’আ করার আদেশ দিতেন এবং তাঁদের দো’আ কবুল করার প্রতিশ্রুতি দিতেন। কিন্তু বর্তমান উম্মতি মুহাম্মদীর জন্য এটি ব্যাপক করে দেয়া হয়েছে। এটি উম্মতি মুহাম্মদীর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। বান্দার যাবতীয় ইবাদত আল্লাহ তায়ালা কবুল করতেও পারেন কিংবা প্রত্যাখানও করতে পারেন। কারণ কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন বলে ওয়াদা দেননি। কিন্তু দোয়া এমন ইবাদত যা কবুল করবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন-“তােমাদের পালনকর্তা বলেন, তােমরা আমার নিকট দোয়া কর, আমি তােমাদের দোয়া কবুল করবাে।(সূরা মুমিন, আয়াত:৬০)
বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকা- এ তো আল্লাহর বিধান অমান্যকারী, কার্যত আল্লাহকে অস্বীকারকারী কাফেররাও করে। পবিত্র কুরআনে একটি উপমায় চিত্রিত করা হয়েছে কাফেরদের এ অবস্থা। লক্ষ করুন-
তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে জলে-স্থলে ভ্রমণ করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও, এগুলো আরোহীদেরকে নিয়ে অনুকূল বাতাসে বয়ে যায় আর তারাও এতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এক ঝড়ো বাতাস তাতে আঘাত হানে এবং সর্বদিক থেকে তরঙ্গ তাদের উপর আছড়ে পড়ে আর তারা মনে করে- তারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডেকে বলে- ‘তুমি যদি আমাদেরকে এ থেকে উদ্ধার কর তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ অতঃপর তিনি যখনই তাদেরকে বিপদমুক্ত করেন তখনই তারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে জুলুম করতে থাকে। -সূরা ইউনুস (১০) : ২২-২৩
আরেক আয়াতের বর্ণনা-তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে ভিড়িয়ে দেন, তখন তারা শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ে! -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৬৫-৬৬
সুতরাং বিপদের সময় আল্লাকে ডাকা মুমিনের বিশেষত্ব নয়। তারা তো সুখে-দুঃখে উৎসবে-সংকটে সর্বাবস্থায়ই আল্লাহকে ডাকে। যে কোনো কাজ করার সময় তারা আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করে। সে কাজটি কঠিন মনে হলেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, এমনকি সহজ মনে হলেও আল্লাহকেই ডাকে। মুমিন বান্দার ফরিয়াদ তো এমন-
হে আল্লাহ! আপনি যা কিছু সহজ করে দেন তা ছাড়া তো সহজ আর কিছুই নেই। আপনি যখন ইচ্ছা করেন তখন দুঃখ-কষ্টকেও সহজ করে দেন। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তিকে আল্লাহর কাছে দোয়া বা প্রার্থনা করতে হবে এবং তা কবুল হয়েছে বলে দৃঢ়বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “আর আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, বস্তুত আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা দোয়া করে তাদের দোয়া কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে দোয়া করে।
কাজেই আমার আদেশ মান্য করা এবং আমার প্রতি বিশ্বাস স্হাপন করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।(সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন- “তোমরা আল্লাহকে ডাক ভয় এবং আশা নিয়ে সন্নিকটে।(সূরা আ’রাফ,আয়াত;৫৬) কেউ কেউ বলেন, জীবন্ত ও সুস্থ অবস্থায় আল্লাহকে ভয়ের মাধ্যমে ডাকলে এবং অসুস্থ ও দুঃসময়ে আল্লাহকে আশা নিয়ে ডাকলে কার্যকরী হয় বেশী।
আল্লাহ তায়ালা আরাে বলেন- “তােমরা তােমাদের প্রভূকে ডাক কাকুতি-মিনতি করে এবং সংগােপনে।(সূরা আ’রাফ, আয়াত;৫৫)
অতএব, দোয়ার মধ্যে বিনয়ী ও নম্রতা, ভদ্রতা থাকতে হবে। কারণ দোয়া হলাে ইবাদত। হাদিস শরীফে আছে “দোয়াই হলাে ইবাদত” অথবা ইবাদতই হলাে দোয়া।(তিরমিজি শরীফ) অন্যত্র বর্ণিত আছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- “দোয়া ইবাদতের মগজ বা মূল”। অর্থাৎ দোয়ার মাধ্যমেই ইবাদত কবুল হয়। (তিরমিজি শরীফ)
সুতরাং যে কোন ইবাদত করার পর আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য দোয়া করা উচিত।
টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে যাবতীয় উপায়-উপকরণ হাতে নিয়েও মুমিন বান্দার একটাই দুআ- আল্লাহ! আপনি সবকিছু সহজ করে দিন! আপনি না চাইলে কোনো কিছুই সহজ হতে পারে না। মোটকথা, ইহকালীন ও পরকালীন সুখ-শান্তির জন্যে, বিপদ থেকে মুক্তির জন্যে এবং সার্বিক কল্যাণের জন্যে মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে দুআ করে থাকে। দুআর আদেশ স্বয়ং আল্লাহর-
তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাঁড়া দেব।-সূরা মুমিন (৪০) : ৬০
দু’আ হচ্ছে বন্দেগি ও দাসত্ব প্রকাশের চূড়ান্ত মাধ্যম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে গুণাবলিতে গুণান্বিত ছিলেন, এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হচ্ছে তাঁর গোলামি ও দাসত্ব। মানুষকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিই করেছেন তাঁর ইবাদত ও দাসত্ব করার জন্যে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি মানুষ ও জিন জাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করেছি। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ৫৬
সঙ্গত কারণেই যে যত বেশি আল্লাহর দাসত্ব করতে পারবে, তার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ততই পূর্ণতা পাবে। নামায, রোযা হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি আমলের মধ্য দিয়ে মানুষ তার প্রভুর ইবাদত ও দাসত্ব করে থাকে। কিন্তু দাসত্বের পূর্ণ রূপ প্রকাশ পায় দু’আর মধ্য দিয়েই। নিজের কোনো প্রয়োজনে কিংবা পরকালীন মুক্তির আশায় সে যখন প্রভুর সামনে হাত তুলে দু’আ করে, কান্নাকাটি করতে থাকে, তখন তার ভেতর-বাহির সবটাই আল্লাহর গোলামিতে ডুবে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশিরভাগ সময়ই দু’আর মধ্যে ডুবে থাকতেন। তাই বলা যায়, দুআ মুমিনের দাসত্ব ও গোলামিতে পূর্ণতা বিধান করে।
দুআ তো কত উদ্দেশ্যেই হতে পারে! আল্লাহর বান্দা আল্লাহর কাছে তার কৃত গুনাহ থেকে ক্ষমা চেয়ে দুআ করতে পারে, তার সংকট ও পেরেশানি থেকে মুক্তি চেয়ে দুআ করতে পারে, তার ঋণ ও অসুস্থতা দূর করে দেয়ার জন্যে দুআ করতে পারে, যে কোনো বৈধ প্রয়োজন পূরণের জন্যেও দুআ করতে পারে। আল্লাহ্র দয়া ও অনুগ্রহ এতটাই উন্মুক্ত, হাদীসের ভাষ্য অনুসারে তিনি প্রতি রাতেই ডেকে ডেকে বলতে থাকেন- কে আছে প্রয়োজন প্রার্থনাকারী, কে আছে গুনাহ থেকে ক্ষমাপ্রার্থনাকারী…। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
রাতের যখন এক তৃতীয়াংশ কিংবা অর্ধেক কেটে যায়, তখন আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে এসে বলতে থাকেন- কোনো প্রয়োজন প্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে দান করব; কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব; কোনো তওবাকারী আছে কি, আমি তার তওবা কবুল করব; দুআ করার মতো কেউ আছে কি, আমি তার দুআয় সাড়া দেব? -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৫৮৯
মুমিন বান্দা যখন আল্লাহকে ডাকে তখন সে সরাসরি আল্লাহ তাআলার সঙ্গেই কথা বলে। মহামহিম প্রভুর সঙ্গে একান্তে এ কথোপকথনের তৃপ্তিই আলাদা! দুআর মধ্য দিয়ে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সেতুবন্ধন রচিত হয়। দুআর পর যদি প্রার্থিত বিষয় অর্জিত হয়ে যায় তাহলে তো হলোই, আর বাহ্যত যদি তা নাও হয় তবে পরম দয়াময় প্রভুর সঙ্গে আবারও একান্তে কথোপকথনের সুযোগ পাওয়া যাবে। ফলে দুআয় আসলেই ব্যর্থতা বলে কিছু নেই। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁকে মন ভরে ডাকার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী মাদরাসা উমর রা. আল ইসলামিয়া, ঢাকা।