এই বিশ্বের পালনকর্তা হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা।তিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। আসমান, জমিন,গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু তাঁরই সৃজন।আল্লাহ আমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি সৃষ্টি কুলের মাঝে মানবজাতিকে সকল সৃষ্টির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন কেবল তাঁর ইবাদত করার জন্য। তাঁর আদেশ ও নিষেধগুলো জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে পালন করার জন্য। কিন্তু জীবনচলার পথে অনেক মানুষই তা ভুলে যান।
শয়তানের কুমন্ত্রণা, প্রবৃত্তির অসৎ তাড়না, পরিবেশ ও সমাজের মন্দ প্রভাবসহ নানা কারণে আল্লাহর কথা অমান্য করেন। আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করেন। আর কিছু মানুষ রয়েছে এমন যারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলেন এবং সেভাবেই জীবন অতিবাহিত করেন। তারা আল্লাহকে ভয় করেন। কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করেন না। সম্পদলিপ্সা আর যশলিপ্সার পেছনে তড়িৎ গতিতে ছুটেন না।
তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘প্রতিপালকের কাছে উপস্থিত হতে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (সূরা নাজিয়াত আয়াত ৪০-৪১)। তবে কোনো মানুষ যে ভুল করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ দুর্বল এবং বিপরীত বা মন্দ কর্মের প্রতি আসক্ত। কোরআনে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই মানব মন্দকর্ম প্রবণ।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত : ৫৩)।
আর মানুষ মাত্রই ভুল। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ত্রুটিশীল ও অপরাধী, আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম তারা যারা তওবা করে।’ (তিরমিজি)। মানুষ অপরাধ করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের কর্তব্য হলো অপরাধের প্রায়শ্চিত্তের জন্য সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নেয়া। আর একজন গোলাম তার মনিবের সামনে মাথা নত করে থাকবে চাই সে দোষ করুক বা না করুক। এটা সাধারণ নিয়ম। স্বাভাবিক নিয়ম।
আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তওবার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে আরও প্রিয় হতে পারেন। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাওবাকারীদের ভালোবাসেন। মহান আল্লাহ তায়ালার অনেকগুলো সিফাতি বা গুণবাচক নামের মধ্যে দুটি হল, গফুর ও গাফফার; যার অর্থ, মহা ক্ষমাশীল। বান্দা যত অপরাধ করুক, ক্ষমতার আঁধার যিনি, মহামহিম যিনি, যার কাছে দয়া ও ক্ষমার অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে, তাঁর কাছে যদি পাপী বান্দা অনুনয়-বিনয় করে, প্রাণের পুরোটা আবেগ উজাড় করে একটু ক্ষমা প্রার্থনা করে, তিনি তাকে ক্ষমা করে দেন। বান্দা ভুল করার পর ক্ষমা চাইলে আল্লাহ অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর তওবা করা তো এক মহৎ গুণ। তা ছাড়া তওবা করা নবীর (সা.) দেখানো ও শেখানো সুন্নত। কেননা বিশ্বনবী (সা.) নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও শুধু শোকরগুজারের জন্য দিনে শতবার পর্যন্ত তওবা করেছেন তিনি। রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং দৈনিক সত্তরের অধিকবার আল্লাহর কাছে তওবা করি।’ (বুখারি)।
অন্য হাদিসে রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর দরবারে তওবা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর; আমিও প্রতিদিন একশবার তওবা করি।’ (বুখারি)। বান্দা যে কোনো অপরাধ করে না কেন,নিরাশ না হয়ে আল্লাহর দয়া ও রহমতের আশায় তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এলেই দয়ালু আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। কোনো অপরাধ যদি হয় মানুষের হক নষ্ট সম্পর্কিত এ ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর কাছে তওবা করলেই হবে না বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে মাফ চাইতে হবে। যদি ওই ব্যক্তি মাফ না করেন তবে আল্লাহও মাফ করবেন না। আর যদি ওই ব্যক্তি মাফ করে দেন তবে আল্লাহও মাফ করে দেবেন। বান্দার অবাধ্যতার পর বান্দাকে অবশ্যই আল্লাহর নাফরমানি ও মানুষের হক নষ্টসহ যাবতীয় পাপাচার থেকে ফিরে আসতে হবে। আর যথাযথ প্রক্রিয়ায় বান্দা ফিরে এলে আল্লাহপাক সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।
যেমন আল্লাহপাক বলেন, ‘হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ; তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইও না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা যুমার, আয়াত : ৫৩)। হাদিসে রয়েছে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বনি আদম! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকবে ও আমার আশা পোষণ করবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব। তোমার থেকে যা কিছুই প্রকাশ পাক, এতে আমি কোনো পরোয়া করি না। হে বনি আদম! তোমার গুনাহ যদি ঊর্ধ্ব আকাশ পর্যন্ত পৌঁছায়, আর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, এতে আমি সামান্য পরোয়া করি না। হে বনি আদম! তুমি যদি আমার কাছে দুনিয়া ভরা গুনাহ নিয়ে আস আর শিরকে লিপ্ত না হয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর, আমি তোমার জন্য জমিন ভরা ক্ষমা নিয়ে উপস্থিত হব।’ (তিরমিজি)। তওবা করলে আল্লাহতায়ালা বান্দার ওপর অত্যন্ত খুশি হন।
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তওবায় আল্লাহতায়ালা এই পরিমাণ খুশি হোন যে, যেমন ধর তোমাদের কেউ গরম মরুভূমিতে উট গাছের ডালে বেঁধে ঘুমিয়ে পড়ল। সে উটের সঙ্গে তার খাদ্য-পানীয়সহ সব আসবাব ছিল। ঘুম থেকে জেগে দেখল তার উটটি আগের স্থানে নেই। এদিক ওদিক খুঁজে কোথাও পাওয়া গেল না। যখন সে একেবারে নিরাশ হয়ে গেল। তখনই দেখল তার উটটি যথাস্থানে রয়েছে। এমন মুহূর্তে সে ব্যক্তি যতটুকু খুশি হবে, কোনো বান্দা তওবা করলে আল্লাহতায়ালা তারচেয়ে বেশি খুশি হন।’ (মুসলিম)।
তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে এলে আল্লাহপাক কেবল গুনাহগুলোই মাফ করে দেন না, বরং আগের অপরাধগুলোকে সওয়াবে পরিণত করে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তাওবা করে, ইমান আনে এবং ভালো কাজ করে, আল্লাহতায়ালা তাদের খারাপ কাজগুলোকে ভালো কাজে পরিণত করে দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর যারা তওবা করে এবং নেক কাজ করে আল্লাহর প্রতি তাদের তাওবা-ই সত্যিকারের তাওবা।’ (সূরা ফুরকান, আয়াত : ৭০-৭১)।
তওবাকারীকে আল্লাহপাক জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ (তওবার বদৌলতে) মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত।’ (সূরা তাহরিম, আয়াত : ৮)। কেবল মুখেমুখে তওবা বললে বা করলেই হবে না; বরং তওবা করতে হবে একনিষ্ঠভাবে। কেননা আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হল, ‘হে ইমানদার! তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি মনে তওবা (তওবাতুন নাসুহা) কর। (সূরা তাহরিম, আয়াত : ৮)।
তাই আমাদেরকে পাপের রাস্তা থেকে চিরদিনের জন্য মনে-প্রাণে ফিরে আসতে হবে। অনুতপ্ত হয়ে অন্যায়কে ঘৃণা করে ন্যায়ের ওপর থাকতে হবে। কোন দোষ-ত্রুটিকে প্রশ্য় দেয়া যাবে না। আর তাওবার জন্য, কোনো ক্ষণ, দিন, সপ্তাহ, মাস বা বছরের অপেক্ষা করা যাবে না। অপরাধবোধ হলেই তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, মাদরাসা উমর রা.আল ইসলামিয়া,ঢাকা।