আল্লাহর সঙ্গে যে কাউকে অংশিদার মানা, আল্লাহর সত্তা ও তাঁর অস্তিত্ব ও গুনরাজিতে কাউকে শরীক করা হচ্ছে শিরক। মানব জাতির সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ বিভিন্নভাবে আল্লাহর সত্তার সাথে অংশীদারত্ব মেনেছে। মানুষ কখনও একাধিক খোদা বানিয়েছে। কখনও খোদাকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে। আবার কখনও বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ও বস্তুকে খোদা বানিয়েছে। কখনও নিজেরাই মূর্তি তৈরি করে তার পূঁজা করেছে। কোন আশ্চর্য বস্তুকে রব্বে ইজ্জতের মাকানে বসিয়েছে। আবার কখনও কখনও শক্তিশালী মানুষকে খোদার মর্যাদা দিয়েছে।
আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে অংশীদারত্ব মনে করা মারাত্মক গুনাহ ও বড় অপরাধ। এটি কবিরা গোনাহ। কুরআনুল কারিমে শিরককে সবচেয়ে বড় জুলুম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিরক সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন– ‘আল্লাহর সঙ্গে শরীক করো না। নিশ্চিত জেনে রেখো শিরক হচ্ছে অতি বড় জুলুম।’ (সুরা লুকমান ১৩)
আল্লাহ তায়ালার সমিপে বান্দা যত বড় ভুল করুক না কেন আল্লাহ সেই ভুল ক্ষমা করে দেন। কিন্তু যে আল্লাহর সাথে শরিক করে আল্লাহ তার এ কৃত পাপ মার্জনা করবেন না। যেমন আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন–’নিশ্চয় জেনো, আল্লাহর সঙ্গে শরীক বানানোর যে পাপ তা তিনি ক্ষমা করেন না। এ ছাড়া অন্য যে কোন পাপ তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেবেন। বস্তুত যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে, সে তো উদ্ভাবন করে নিয়েছে এক গুরুতর মিথ্যা।’ (সুরা নিসা ৪৮)
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির কল্যাণের স্বার্থে মানবজাতিকে এক অমোঘ সত্য উপদেশ দিচ্ছেন।তিনি বলেন–’তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহরই দাসত্ব ও ইবাদত করো। আর অন্য কোন কিছুকেই তাঁর সঙ্গে শরীক করো না।’ (সুরা নিসা ৩৬)
একজন মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো রবের সাক্ষাত। এ ছাড়া তার কোন চাওয়া পাওয়া নেই। এ সাক্ষাত লাভের ক্ষেত্রে বান্দাকে শিরক ছাড়তে হবে।আল্লাহ ইরশাদ করেন-অতএব যে ব্যক্তি তার রবের সঙ্গে সাক্ষাত লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে সে যেন নিষ্ঠার সঙ্গে সৎকর্ম সম্পাদন করতে থাকে আর তার রবের দাসত্ব, ইবাদ-বন্দেগিতে যেন অপর কাউকেও শরীক না করে।’(সুরা কাহাফ১১০)
শিরক সম্পর্কে হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত,তিনি বলেন নবী করীম (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে যে, সে তাঁর সঙ্গে শিরক করে না, সে অবশ্যই বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর যে তাঁর সঙ্গে শিরক করা অবস্থায় সাক্ষাৎ করবে, সে জাহান্নামে যাবে।’ (মুসলিম)
অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে,হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (সা.) বলেছেন, কবীরা গোনাহ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, কাউকে হত্যা করা ও মিথ্যা শপথ করা। (বুখারী)
একজন মানুষ সারাজীবন যদি ভালো কাজ করে। ভালো কাজ করতে করতে জীবন ফানা করে দেয় আর এমতাবস্থায় লোকটা শিরক করে। তাহলে তার এত এত ভালো কাজ তার কোন উপকারই করবে না।
হযরত লুকমান তার ছেলেকে শিরক করা থেকে বিরত থাকার নসিহত দেয়ার সময় এ কথা বলেন। কুরআনে এসেছে– যখন লোকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল- হে ছেলে! আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো না। নিশ্চয় আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরিক করা মহা জুলুম। ’ (সুরা লোকমান : ১৩)
শিরক দুই প্রকার। এক. শিরকে আকবার,আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করা। অথবা যেকোনো ধরনের উপাসনা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর জন্য নিবেদন করা। যেমন—আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশে প্রাণী জবেহ করা ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা তাঁর সঙ্গে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না। তবে শিরক ছাড়া অন্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৪৮)
দুই. শিরকে আসগার বা ছোট শিরক। রিয়া অর্থাৎ লোক দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আমল করা ইত্যাদি। এটিও শিরক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব দুর্ভোগ সেসব মুসল্লির, যারা তাদের সালাত সম্পর্কে উদাসীন। যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে। ’ (সুরা : মাউন, আয়া : ৪-৬)
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি অংশীদারি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যে ব্যক্তি কোনো কাজ করে আর ওই কাজে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে, আমি ওই ব্যক্তিকে তার শিরকে ছেড়ে দিই। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৫৩০০)
শিরকের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁর সঙ্গে করা শিরকের গোনাহ ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্যান্য যত গোনাই হোক না কেন, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেছে সে তো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গোনাহের কাজ করেছে। (সুরা নিসা : আয়াত ৪৮)
আল্লাহ তাআলা শিরককারীর জন্য জান্নাত হারাম করেছেন। তাদেরকে জালিক বা অত্যাচারী ঘোষণা করে তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী থাকবে না বলেও ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেছে; আল্লাহ তাঁর ওপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার পরিণতি হবে জাহান্নাম। এ সব জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই। ’ (সুরা মায়িদা : আয়াত ৭২) আল্লাহ তাআলা শিরকের ভয়াবহতা উল্লেখ করে পূর্ববর্তী নবিদেরকে সতর্ক করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যদি তাঁরা (সব নবি-রাসুলগণ) শিরক করতো তবে অবশ্যই তাদের করা সব নেক আমল বরবাদ হয়ে যেত। ’ (সুরা আনআ’ম : আয়াত ৮৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অত:পর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। ’ (সুরা হজ : আয়াত ৩১)
সর্বোপরি আল্লাহর আযাব থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তাওবাহ করতে হবে। তাওবাহ ছাড়া আল্লাহ তাআলা শিরকের গোনাহ ক্ষমা করবেন না। আমাদের উচিত এক আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা। আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় তার কোন শরিক নেই এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে শিরক মুক্ত জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, মাদরাসা উমর রা.আল ইসলামিয়া, ঢাকা।