চীনের কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক এক কংগ্রেস আজ রবিবার শুরু হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে রাজধানী বেইজিংয়ে কঠোর নিরাপত্তা জারি করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এটি কমিউনিস্ট পার্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা এবং এতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তৃতীয় মেয়াদের জন্য পার্টির নেতা নির্বাচিত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। এই কংগ্রেসে শি চীনের রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং পার্টিতে তার দৃঢ়মুষ্টি আরো সংহত করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। এদিকে কমিউনিস্ট পার্টির এক মুখপাত্র বলেছেন, তাইওয়ানে শক্তি প্রয়োগ করার অধিকার চীনের রয়েছে।
ইতিহাস সৃষ্টি করবেন শি জিনপিং
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক এই পার্টির সম্মেলন একটি বড় বিষয়। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে দল ও দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হবে। এই কংগ্রেসেই বোঝা যাবে—আগামী পাঁচ বছরে চীন কীভাবে অসংখ্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে। এই চ্যলেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে কোভিড-১৯ এবং মন্থর অর্থনীতি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কঠিন সম্পর্ক পর্যন্ত। এগুলো চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং ভৌগোলিক প্রভাবের জন্য বাড়তি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসে প্রায় নিশ্চিতভাবেই দলটির নেতা শি জিনপিং তৃতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক হতে যাচ্ছেন। আর এর মধ্য দিয়ে শি জিনপিং চীনের প্রেসিডেন্ট ও কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও থেকে যাচ্ছেন। নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন ১৯৭৬ সালে মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর থেকে এই প্রথম এমন চীনা নেতা, যিনি দুই মেয়াদের বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করবেন। আর মাও এবং তার উত্তরসূরি দেং জিয়াওপিংয়ের পর তিনি হবেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা। এটি একটি স্পষ্ট লক্ষণ যে, তিনি ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ক্ষমতা সুসংহত করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার বদলে দেশটি একজন ক্ষমতাধর নেতার শাসনের দিকে ফিরে যাচ্ছে। অনেকেই মনে করেন এমনও হতে পারে যে ৬৯ বছরের শি জিনপিং আজীবনের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখবেন। বিশ্লেষকদের মতে, এই কংগ্রেসে নীতিগত কোনো বড় পরিবর্তন আশা করা যাচ্ছে না।
কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কংগ্রেস শুরু হওয়ার আগেই চীনে শি জিনপিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিকদের নানা দুর্নীতির অভিযোগ এনে সাজা দেওয়া হয়েছে। সান লিজুন জননিরাপত্তা বিষয়ক সাবেক ভাইস মিনিস্টার। ঘুষ নেওয়া এবং অবৈধভাবে অস্ত্র রাখার দায়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন যেমন সাবেক বিচারমন্ত্রী ফু জেংহুয়া, পূর্ব জিয়াংসু প্রদেশের রাজনৈতিক ও আইনি বিষয়ের সাবেক প্রধান ওয়াং লাইক এবং তিন জন সাবেক পুলিশপ্রধান। শৃঙ্খলা পরিদর্শন কমিশনের সাবেক প্রধান লিউ ইয়ানপিংকেও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ব্রুস ডিকসনের মতে, এসব কারাদণ্ডের অর্থ হচ্ছে, শি জিনপিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেই আপনাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
‘তাইওয়ানে শক্তি প্রয়োগের অধিকার আছে’
কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম মুখপাত্র সান ইয়েলি বেইজিংয়ে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করতে শক্তি প্রয়োগের অধিকার আমাদের আছে। তবে আমাদের প্রথম পছন্দ শান্তিপূর্ণভাবে তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে একত্রিত করা। তাইওয়ানকে একত্রীকরণ উভয়ের স্বার্থের জন্যই কল্যাণকর বলে মনে করেন মুখপাত্র।
বিরল প্রতিবাদ
বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ের হাইডান জেলার সিটং ব্রিজের ওপর এই অভিনব এবং বিরল প্রতিবাদ হয়েছিল। প্রতিবাদকারী ব্রিজের ওপর থেকে দুটি ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়। এর একটিতে চীনের অনুসৃত কঠোর ‘জিরো কোভিড’ নীতি বাতিলের দাবি জানানো হয়। আরেকটিতে শি জিনপিংকে ক্ষমতা থেকে উত্খাতের ডাক দেওয়া হয়। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভকারীকে আটক করে। অনেকে এই বিক্ষোভকারীর প্রশংসা করে তাকে ‘বীর’ বলে বর্ণনা করেন। অনেকে তাকে তুলনা করেন, তিয়ানানমেন স্কয়ারের সেই বিক্ষোভকারীর সঙ্গে, যিনি ১৯৮৯ সালের বিক্ষোভের সময় একটি ট্যাংকের পথরোধ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই ব্যক্তি গবেষণা বিষয়ক একটি ওয়েবসাইট ‘রিসার্চগেটে’ সমপ্রতি একটি ইশতেহার আপলোড করে। এটি পরে সরিয়ে নেওয়া হয়, কিন্তু সেটির কপি অনেকে আবার অন্যান্য জায়গায় প্রকাশ করেছে। ২৩ পৃষ্ঠার এই ইশতেহারে আজ রবিবার একটি ধর্মঘট এবং আইন-অমান্য আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। এতে কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালাতে বলা হয়। এতে বলা হয়, ‘স্বৈরশাসক শি জিনপিং যেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে না পারে এবং চীন যেন গণতন্ত্রের পথে যেতে পারে সেজন্যে এই আন্দোলন।’ চীনে এ ধরনের প্রতিবাদ এক বিরল ঘটনা। এই প্রতিবাদের পর বেইজিংয়ে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। —বিবিসি, রয়টার্স ও আলজাজিরা