মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়ক জনতার রায়ে নির্বাচিত নয়। তবে বাংলাদেশের সরকার জনগনের দ্বারা নির্বাচিত। তাই আরব বিশ্ব ফিলিস্তিন ইস্যুতে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না। ব্রাজিলের মতো নন মুসলিম দেশ ইসরাইলের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করলেও কোন মুসলিম রাষ্ট্র এ পর্যন্ত এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। ওআইসি ও আরব লীগ একাধিকবার বৈঠকে বসলেও তারা ইসরাইলি পণ্য বয়কটে এক হতে পারে নি। ইসরাইলের সাথে আমাদের কোন বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকলেও তাদের, ও তাদের মিত্রদের অনেক পণ্য আমাদের দেশে বিক্রি হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের ই-পাসপোর্ট থেকে একসেপ্ট ইসরাইল (Except Israel) শব্দটি ডিলিট করা দুঃখজনক। আমি পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালিন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অন্য কেউ আমার সাথে এ বিষয়ে কোন আলোচনা না করেই এ পরিবর্তন করেছে। পাসপোর্টকে আরো মানসম্পন্ন করা এবং খরচ কমানোর জন্য জার্মানি একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজটি করেছে বলে আমাকে অভিহিত করা হয়। জাতিসংঘের নিজস্ব শক্তি বলতে কিছু নেই। পাঁচটি মোড়ল রাষ্ট্রের ওপর তারা নির্ভরশীল। ১৫ হাজার শিশুসহ ৩৬ হাজার মানুষকে হত্যার পরও মানবতার ফেরিওয়ালারা ফিলিস্তিনে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোন ভূমিকা রাখেনি। পশ্চিমাদের বাদ দিয়ে আরব বিশ্ব এক হলেও ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ফিলিস্তিন ও ইসরাইল দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমেই বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আজ (৩১ মে, ২০২৪ শুক্রবার) এফডিসিতে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন নিরসনে করণীয় নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ.কে আব্দুল মোমেন এমপি এসব কথা বলেন। সভাপতিত্ব করেন আয়োজক সংগঠন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান জনাব হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে সমর্থন করা নিয়ে কোন বিভক্তি নেই। সবাই ফিলিস্তিনের পক্ষে। ফিলিস্তিনিদের লড়াই একক কোন লড়াই নয়। এ লড়াই সারা পৃথিবীর মানুষের লড়াই। এই লড়াই বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে আমাদেরও লড়াই। ফিলিস্তিনের মানুষের যে নিরব কান্না তা সারা বিশ্বের বিপন্ন আর্তমানবতার চিৎকার। গাজায় যে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, নৃশংসতা ও অমানবিকতা ঘটেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কালো অধ্যায়। ফিলিস্তিনের প্রত্যেকটি মানুষ এখন জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। খাদ্য নেই, পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, চিকিৎসা নেই। হাসপাতালে লাশের সারি। চারিদিকে মৃত মানুষের পচা লাশের গন্ধ। বেঁচে থাকা মানুষগুলো যেভাবে বেঁচে আছে তা বেঁচে থেকেও মরে যাওয়ার মতো। অনেক জায়গায় দেখা গেছে পরিবারের সবাই মারা গেলেও লাশ সনাক্তের জন্য হয়তো দুই একজন বেঁচে আছে। সন্তানের ছিন্ন বিছিন্ন লাশ সনাক্ত করতে পারছে না বাবা-মা। মাথার খুলি ভাঙ্গা, ছিন্ন বিছিন্ন অনেক শিশুর লাশ হাসপাতালে আনা হচ্ছে। তাই অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের শরীরের বিভিন্ন অংশে নাম লিখে রাখছেন। যাতে হামলায় মারা গেলেও নিজ সন্তানের মৃতদেহটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই বর্বরতার অবসান হওয়া উচিৎ।
জনাব কিরণ আরো বলেন, দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর মতবিরোধ ও রাজনৈতিক বিভক্তি ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রসনকে উসকে দিয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও ইরানের শিয়া-সুন্নি বিরোধ মুসলিম বিশ্বের ঐক্যকে দুর্বল করেছে। আবার কিছু কিছু মুসলিম রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সরাসরি ইসরাইলের বিপক্ষে যায়নি। ওআইসি এবং আরব লীগসহ মুসলিম দেশগুলোর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব সংস্থাগুলো ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শুধু নিন্দা ও বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। অন্যদিকে এমন এক সময় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা গেলেন, যখন মধ্যপ্রাচ্য ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে। ইতোমধ্যেই ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন ইরানের প্রেসিডেন্টকে বহনকারী আমেরিকার তৈরি হেলিকপ্টারটিকে হাইপারসনিক স্পেস লেজার দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। যদিও ইরানের পক্ষ থেকে এখনো সরাসরি কোন মন্তব্য করা হয়নি।
ফিলিস্তিন ইসরাইল সংকট নিরসনে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান নিম্নের ৭ দফা পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ উপস্থাপন করেন।
সুপারিশসমূহ: মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত হয়ে শিয়া-সুন্নি বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে ফিলিস্তিন সমর্থিত রাষ্ট্র প্রধানদের নিয়ে ইসরাইলের পক্ষপাতিত্বকারী দেশগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে; বিশ্ব গণমাধ্যম পক্ষপাতহীনভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত হামলার চিত্র তুলে ধরে ইসরাইলের বিপক্ষে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে; জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দেশগুলোর মধ্যস্ততায় উভয়পক্ষের অংশগ্রহণে শান্তিচুক্তি নিশ্চিত করা; ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল উভয়ের জন্য আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা; ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল উভয়কে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার মানদন্ড মেনে চলতে হবে। যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের ব্যবস্থা করা, জরুরী ভিত্তিতে গাজা উপত্যকাসহ ফিলিস্তিনে বেঁচে থাকা মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা নিশ্চিত করা, ফিলিস্তিনি জনগণের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, শিক্ষা নিশ্চিত করাসহ অবকাঠামো পুনঃনির্মাণে আন্তর্জাতিক তহবিল গঠন করা।
“মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই পারে ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসন বন্ধ করতে” শীর্ষক ছায়া সংসদে কবি নজরুল সরকারি কলেজের বিতার্কিকদের পরাজিত করে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, সাংবাদিক ঝুমুর বারী, সাংবাদিক এ কে এম মঈনুদ্দিন, সাংবাদিক একরামুল হক সায়েম, সাংবাদিক মাসুদ করিম। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।