উপকূলীয় জেলা বরগুনায় সরবরাহ বাড়লেও দাম কমেনি ইলিশ মাছের। ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়ালে দাম কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তবে বরগুনার বাজারগুলোতে ইলিশের মূল্য নির্ধারণের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহনের আশ্বাস দিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: মহসীন। ভারতে ইলিশ রপ্তানিতে দেশের মৎস্য খাতে কোন প্রভাব পরবে না বলে মনে করছেন এই মৎস কর্মকর্তা। গত বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সকালে বরগুনার পৌর মাছ বাজার, তালতলী ফকির হাট ও পাথরঘাটার দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে গত কয়েকদিন চেয়ে বুধবার (২৫সেপ্টেম্বর) ইলিশের সরবরাহ বেড়েছে। বড় সাইজের ইলিশ কম ধরা পরলেও মাঝারি ও ঝাটকা ইলিশ বেশি দেখা গেছে এসব বাজারগুলোতে। কোল্ড ষ্টোরেজ ও পর্যাপ্ত বরফ মিল না থাকায় এসব বাজারজাত হওয়া এ ইলিশ মাছের সিংহভাগ প্রতিদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। স্থানীয় বাজারগুলোতে পায়রা ও বিষখালী নদীর মিঠা পানির সুস্বাদু ইলিশ বিক্রি করা হয়। পায়রা ও বিষখালী নদীর মিঠা পানির ইলিশ সুস্বাদু হওয়ায় দেশজুড়ে ব্যাপক চাহিদা থাকায় “বিডি ফিসার ম্যান ” নামের ফেসবুক পেইজে যোগাযোগ করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নিজ ঠিকানায় সুস্বাদু ইলিশ নিচ্ছেন ক্রেতারা। জেলার বিভিন্ন উপজেলার ট্রলার মালিক ও জেলেদের সাথে প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে তারা নবচেতনা কে জানান, অবরোধ শেষ হওয়ার পরে যখন সমুদ্রে মাছ ধরতে যাবে ঠিক তখনই উপকূলীয় জেলা বরগুনার জেলেদের রোজগারের পথ আগলে দাড়ায় বৈরি আবহাওয়া। আবহাওয়ার এ প্রতিকূল পরিবেশে বরগুনা উপকূলের বেশিরভাগ মাছ ধরার ট্রলার ঘাটেই নোঙর করে রাখা হয়। অল্প কিছু সংখ্যক ট্রলার সমুদ্রে ইলিশ শিকারে গেলেও তাদের বেশির ভাগই ফিরেছেন খালি হাতে। ফলে লোকসান গুণতে হয়েছে ট্রলার মালিকদের। তবে গত দু’দিন ধরে বরগুনা উপকূলে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় জেলেদের জালে বেশি সংখ্যক ইলিশ ধরা পরতে শুরু করেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলে নকি ইলিশ বেশি পাওয়া যায় বলে পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এমনটিই জানিয়েছেন স্থানীয় বৃদ্ধ জেলেরা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পাথরঘাটা বিএফডিসিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৩৫ হাজার টাকা, ১ কেজি বা তার উপরের ওজনের ইলিশ ৭২ হাজার টাকা মন দরে বিক্রি হচ্ছে । মঙ্গলবার (২৫সেপ্টেম্বর) সকালে পাথরঘাটা বিএফডিসিতে প্রায় ৭০ মন ইলিশ কেনাবেচা হয়েছে। চলতি মৌসুমে যে পরিমাণ ইলিশের উৎপাদন হওয়ার কথা ছিলো তার তুলনায় অর্ধেক পরিমানেও উৎপাদনও হচ্ছে না বলে নবচেতনাকে জানিয়েছেন পাথরঘাটা বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ। অবরোধের পূর্বে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ মন ইলিশ কেনাবেচা হতো। ভারতে ইলিশ রপ্তানি করলে এ অবতরণ কেন্দ্রে তেমন কোন প্রভাব পরবে না বলে মনে করছেন তারা। এছাড়াও বিএফডিসি ঘাটে ট্রলার নিয়ে ইলিশ বিক্রি করতে আসা কয়েকজন জেলেদের সাথে কথা হলে তারা নবচেতনা কে জানান, ইলিশ মূলত যখন বেশি পাওয়া যায়, তখন দেশের সমুদ্রসীমায় ৬৫ দিনের অবরোধ থাকে, ঠিক ওই সময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অবরোধ না থাকায় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সীমানায় এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে অনেক মা ইলিশ ধরা পরে ডিম ছাড়তে না পারায় আমাদের দেশে ইলিশ উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারন হিসেবে মনেকরছেন এসকল জেলেরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে মিল রেখে যাতে ৬৫ দিনের অবরোধের সময়টা নির্ধারণ করা অথবা ৬৫ দিনের অবরোধের সময় দেশের সমুদ্রসীমায় ভারতীয় জেলেদের মাছ শিকার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য দেশের সরকার প্রধানসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন তারা। এদিকে সমুদ্র থেকে ফিরে তালতলী ফকিরহাটে মাছ বিক্রি করতে আসেন রিপন সর্দার নামের এক জেলে। এসময় তার সাথে কথা হলে তিনি নবচেতনা কে জানান, এইবারে ৪০০ কেজির উপরে ইলিশ শিকার করেছেন তিনি। বাজারে দামও মোটামুটি ভালোই। তালতলী ফকিরহাট বাজারের মৎস্য আড়ৎদার এমাদুল হক নবচেতনা কে বলেন, সামুদ্রিক ইলিশ ৫০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রামের মন প্রতি ৫০ থেকে ৫২ হাজার, ৭০০ গ্রাম ওজনের প্রতি মন ৫২ থেকে ৫৪ হাজার টাকা, এছাড়াও সাইজ, ওজন ও ধরা পরা ইলিশের পরিমানের উপর দাম উঠানামা করতে পারে। আজকে যে পরিমান ইলিশ ধরা পরেছে এভাবে ধরা পরলে বাংলাদেশের মানুষ কয়টা ইলিশ খেতে পারবে। তবে ভারতে ইলিশ রপ্তানি একটি ভালো বিষয় হিসেবে দেখছেন বলে মন্তব্য করে বলেন, গত বছরের এমন সময়ে ৫০০-৬০০ গ্রামের মাছ আমরা ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। এবছর ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। বরগুনা পৌর মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতিকেজি ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা, ৮০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের প্রতিকেজি ইলিশ ১৫০০ টাকা থেকে ১৭০০টাকা, ১কেজি বা তার উপরের প্রতিকেজি ওজন অনুসারে ১৮০০ টাকা ২২৫০ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। ইলিশের বাড়িখ্যাত বরগুনায় এত চড়া দাম হওয়ায় নাভিশ্বাস ফেলছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। পৌর মাছ বাজারে মাছ বিক্রি করতে আসা সদর উপজেলার ১নম্বর বদরখালী ইউনিয়নের ডেমা গ্রামের জেলে হাবিবের সাথে কথা হলে একগাল হাসি দিয়ে চোখেমুখে খুশির ঝিলিক নিয়ে নবচেতনা কে বলেন, এতদিন তো মাছ পাই নাই। আজকে মোটামুটি ভালোই ইলিশ পাইছি, দামও ভালো আছে। ভালো যোগাযোগের অভাবে বরগুনা সদরে সাশ্রয়ী দামের সামুদ্রিক ইলিশ না আসায় স্থানীয় নদীর ইলিশের দাম একটু বেশি বলে জানিয়েছেন কামাল হোসেন নামের এক খুচরা মৎস্য ব্যবসায়ী। খুচরা বাজারে ইলিশ কিনতে আসা রফিক সাধ্যের মধ্যে দুটি ঝাটকা ইলিশ কিনে যাওয়ার সময় নবচেতনা প্রতিবেদকের সাথে কথা। এসময় তিনি ভোরের ডাককে বলেন, কৃষি জমিই আমার একমাত্র আয়ের উৎস। ইলিশের যা দাম আর এভাবে যদি থাকে তাতে আমাদের মত শ্রেণির মানুষ বছরে দুই-তিন ইলিশ মাছ কিনে খেতে পারবে। আরো যদি দাম বাড়ে তাহলে ইলিশ মাছ আমাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। বরগুনা পৌর ক্ষুদ্র মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির লিটন নবচেতনা কে বলেন, অবরোধ শেষ হওয়ার পরে জেলেদের জালে ধরা না পরায় বাজারে স্বল্প পরিমানে ইলিশ আসতো। তবে মঙ্গলবার বরগুনায় মাছ বাজারে ইলিশ বেশি পরিমানে বাজারজাত হয়েছে। তবে চাহিদা থাকায় দাম আগের মতই একটু বেশি। এখানে কোল্ড ষ্টোরেজ নেই ও একটি মাত্র বরফ মিল, তাছাড়া সংরক্ষণের অভাবে সামুদ্রিক ইলিশ না আসায় বরগুনায় ইলিশ মজুদ করা সম্ভব নয়।দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাহিদা বেশি থাকায় দাম একটু বেশি। তবে উৎপাদন বাড়ানো গেলে ইলিশের দাম কমানো সম্ভব বলে মনেকরি। তিনি আরো বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় সরকার আরোপিত ২২দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় যদি জেলেরা মা ইলিশ শিকার করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে এবং নদীতে প্রশাসনিক তৎপরতা আরো জোরদার করা হয় তাহলে ইলিশের উৎপাদন বাড়াবে। কারণ প্রজনন মৌসুমে প্রতিটি মা ইলিশ প্রায় ২২ লক্ষ ডিম ছাড়তে সক্ষম। বাজারে ইলিশের সরবরাহ বাড়লেও চড়া দামে ইলিশ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: মহসীন নবচেতনা কে বলেন, বাজারের মূল্য নির্ধারণের জন্য আমাদের একটি কমিটি রয়েছে। তারাই মূল্য নির্ধারণ করবেন। ইতিমধ্যে এবিষয়ে আমাদের মিটিংও হয়েছে, দ্রুত এবিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিষয়ে তিনি আরো বলেন, প্রতিবছর দেশে প্রায় লক্ষ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়। সেখান থেকে মাত্র তিন হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করা হলে মৎস্য খাতে তেমন কোন প্রভাব পরবে না বলে মনে জয়। বরগুনা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বরগুনা জেলা শাখার সহকারী পরিচালক বিপুল বিশ্বাস নবচেতনা কে বলেন, আড়ৎগুলোতে চালান নিয়ে কারসাজির অভিযোগে সঠিকভাবে চালান লেখার জন্য কয়েকদিন আগেও অভিযান চালিয়ে তাদের মুচলেকা নিয়ে এসেছি। ইলিশের দামের বিষয়টি নিয়েও আমরা বাজারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে।