উজানে ভারি বর্ষণ ও নেমে আসা ঢলে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার ফলে নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষের মাঝে বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তিস্তা নদী এলাকায় হলুদ সতর্ক সংকেত জারি করা হয়েছে। রংপুর, নীলফামারী, লালমনিররহাট, কুড়িগ্রামে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তার উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে গত ৫ দিনে তিস্তা নদীর পানি সমতল পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছিল। সোমবার সকাল ৬ টায় বিপদসীমা অতিক্রম করে ডালিয়া পয়েন্টের পানি ৫২ দশমিক ২০ মিটারে প্রবাহিত হয়েছে। এই পয়েন্টে বিপদসীমা ধরা হয় ৫২ দশমিক ১৫০ সেন্টিমিটার। তবে ৯ টায় পানি কিছুটা কমে ডালিয়া পয়েন্টের পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টি মিটার নিচে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়া বিকেল ৩টায় ধরলা নদী কুড়িগ্রাম পয়েন্টে ১ দশমিক ২৪ মিটার, তালুক শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ১ দশমিক ৩১ মিটার, দুধকুমার নদী পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৫০ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদী নুনখাওয়া পয়েন্টে ২ দশমিক ৯০ মিটার, চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা উপজেলার মানুষের মাঝে বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। লক্ষীটারি ইউনিয়নে প্রায় ২০০০ পরিবার, গজঘন্টা ইউয়নে শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়েছেন বলে স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানান। এদিকে কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গঙ্গাচড়ার লহ্মীটারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় তার ইউনিয়নে জয়রাম ওঝা, কেল্লারপাড়, শংকরদহ, বাগের হাট, চর ইচলি এলাকার প্রায় আড়াই হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। সবাই সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। গজঘণ্টা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বলেন, রোববার সকালে বয়ে যাওয়া ঝড়ে তার ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানে ও দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সকল প্রধান নদ-নদীগুলো পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমার নদীর অববাহিকা ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। যার ফলে এসব নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। সেই সাথে আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এদিকে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানী ইউনিয়ন ছাতুনামা ও ভেন্ডাবাড়ী, খালিশা চাপানী ইউনিয়ন ছোটখাতা, বাইশ পুকুর, উত্তরা বাজার, খগাখড়িবাড়ী ইউনিয়ন কিশামত চর প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় ভোগান্তিতে পরেছে তিস্তাপাড়ের মানুষ। চর এলাকায় চাষাবাদের জন্য বসবাসরত লোকজন উচু এলাকায় চলে আসছেন। জুনাগাছ চাপানি চেয়ারম্যান একরামুল হক চৌধুরী বলেন, তার দুটি ওয়ার্ডে কয়েকশ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তাপাড়ের সবার মাঝে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা জানিয়েছেন, ডালিয়ার তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। এদিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধির ফলে লালমনিরহাট জেলার তিস্তা নদীর ভাটিতে থাকা হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী ও সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, সদর উপজেলার রাজপুর ও খুনিয়াাগাছ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিস্তার চরসহ নিম্নাঞ্চলে আবাদ করা বাদাম, পাট, সবজিসহ মৌসুমি ফসলগুলো ডুবে গেছে। হাতিবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, তার ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়ে ২ হাজার পাড়ির মানুষ পানি বন্দি অবস্থায় রয়েছে। নিচু এলাকার লোকজনকে সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে। এদিকে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার পাঁচগাছী ইউনিয়নের শুলকুর বাজার এলাকার কৃষক আহমেদ আলী জানান, কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাতের ফলে খাল বিল সব ভরে গেছে। এদিকে ধরলার পানিও দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বাড়ির পাশে অবস্থান করছে। যেকোন সময় পানি বাড়িতে উঠতে পারে। পটল ক্ষেত, ঢেড়স ক্ষেত, পাট ক্ষেতসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ-আল-মামুন জানান, জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও এখনও বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগামী ২২ ও ২৩ জুন এসব নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী জানতে পেরেছেন। অপরদিকে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নসহ মেষ কিছু চলাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যেসব গ্রাম প্লাবিত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে চর মাদারী পাড়া, কানি চরিতাবাড়ী, পাড়াসাধু। হরিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নাফিউল ইসলাম জিমি বলেন, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় এলাকায় বন্যা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। লোকজন সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
বিপৎসীমার ওপরে সুরমার পানি: সিলেটে টানা ছয়দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরে। সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ছে বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। আবার নগরের নিম্ন এলাকায় জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে সিলেটের উজানে ভারতের আসামেও ভারী বৃষ্টির কারণে সেখানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও সিলেটে টানা বৃষ্টির কারণে সিলেটের নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে গতকাল সোমবার বিকেল ৩টায় সুরমার পানি বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা হচ্ছে ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত ২১ ঘণ্টায় কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩৭ সেন্টিমিটার। এছাড়া সিলেট সদর পয়েন্টে সুরমার পানি বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই অবস্থা। সুরমা নদীর সিলেট সদর পয়েন্টে বিকেল ৩টায় পানি বিপৎসীমার ১০ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই পয়েন্টে বিপৎসীমা হচ্ছে ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। গত ২১ ঘণ্টায় সদর পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৩৩ সেন্টিমিটার। এছাড়া পানি বেড়েছে সিলেটের কুশিয়ারা, ধলাই, লোভা ও সারী নদীতে। সোমবার নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, টানা বর্ষণের ফলে নগরের মদিনা মার্কেট, আখালিয়া, আখালিয়ায় নতুন বাজার, সুবিদবাজারের নুরানী, ছড়ারপাড়সহ বেশ কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক এলাকায় সড়কে হাঁটুপানি দেখা গেছে। জলাবদ্ধতায় বিভিন্ন এলাকার সড়ক জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চলাচলেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছেন বেশি। আখালিয়া এলাকার শাহীন আহমদ জানান, শেষ রাতে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এখনো থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। আখালিয়া নয়াবাজার সড়কে পানি, বাসার সামনে পানি। মানুষ কষ্টে আছে। সিলেট সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, দ্রুতগতিতে এই পানি নেমে যাবে। সিটি করপোরেশনের একাধিক দল মাঠে কাজ করছে। সিলেট আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসাইন বলেন, ভোর থেকে শুরু করে বেলা ১১টা পর্যন্ত সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১২ আর সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ৫১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এছাড়া সারাদিন থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
সুনামগঞ্জে বন্যা আতঙ্কে ২০ লাখ মানুষ: সময়টা যেন একদম ভালো যাচ্ছে না সুনামগঞ্জবাসীর। অঝরে ঝরে চলেছে বৃষ্টি। থামার যেন কোনো লক্ষণ নেই। আরও দুই-তিন দিন এভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে বন্যার কবলে পড়বে সুনামগঞ্জের ২০ লাখেরও বেশি মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে সুরমা, যাদুকাটা, রক্তি নদীর পানি বাড়লেও বিপৎসীমার ৭৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী নিম্নাঞ্চলে এরইমধ্যে ঢলের পানি ঢোকায় ও সব ধরনের রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ৩ লাখেরও বেশি মানুষ। এমনকি অনেকেই এরইমধ্যে বসতভিটার সব আসবাবপত্র নৌকায় করে উঁচু স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, নদীর পানি বাড়ায় প্রতিনিয়ত আতঙ্কে রয়েছেন তারা। নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দা পেয়ারা বেগম বলেন, গত বছর বন্যার পানিতে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সেজন্য এ বছর পানি পুরোপুরি আসার আগে ঘরের আসবাবপত্র নৌকায় করে নিয়ে উঁচু স্থানে নিয়ে যাচ্ছি। স্থানীয় বাসিন্দা ফজু আহমেদ বলেন, যেভাবে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত আছে আমরা খুব আতঙ্কে আছি। তবে স্বস্তির বাণী শোনাতে পারেননি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টা সুনামগঞ্জে অতিভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এতে সুনামগঞ্জের সব নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।