বদ্ধ সেপটিক ট্যাংকে অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই অক্সাইড সহ সালফারের অন্যান্য গ্যাস, মিথেন , এমনকী বিষাক্ত কার্বন মোনোক্সাইড তৈরি হতে পারে। বদ্ধ থাকার ফলে এসব গ্যাস ক্রমশ ঘন হতে থাকে, এবং সেই সাথে অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হতে থাকে। কখনো কখনো এ ধরনের বদ্ধ কূপ একেবারে অক্সিজেন শূন্য হয়ে যেতে পারে। যার ফলে এসব গর্তে ঢুকলে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ বা যে কোনো প্রাণী দ্রুত অচেতন হয়ে যেতে পারে এবং তার জীবন হুমকিতে পড়তে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সাধারণ শ্রমিক অক্সিজেন বুঝে না। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হতে পারে সেটা জানেনা। সাভারের আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারে নেমে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। তারা হলেন—পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিঠু (১৬), পোশাক শ্রমিক রাকিব (২২) ও মোহাম্মদ আলী (২৬)। ১৫ মার্চ বুধবার রাত ১০টার দিকে আশুলিয়ার শিমুলতলার দরগারপাড় এলাকার আল রহমান নিটিং ফ্যাশন বিডি লিমিটেডের সেপটিক ট্যাংক থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বিকেল ৩টার দিকে ওই কারখানার সেপটিক ট্যাংকে নেমে তাদের মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টার দিকে প্রথমে পরিচ্ছন্নতাকর্মী মিঠু ওই সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে নামেন। ঘণ্টাখানেক পরও তার কোনো সাড়াশব্দ না পেলে রাকিব তার খবর নিতে সেপটিক ট্যাংকে নামেন। এরপর তারও কোনো খবর না পেয়ে মোহাম্মদ আলী নামলে তিনিও সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে নিখোঁজ হন। রাত ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিলে ঘটনাস্থলে এসে দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে তাদের মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ঢাকা ইপিজেড ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে সেপটিক ট্যাংক থেকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করেছি। এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। দেশে প্রায়শই সেপটিক ট্যাংকে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এটা প্রতিরোধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। মূলত সচেতনতার অভাবেই ঘটছে এই ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। আর দরিদ্র শ্রেণির লোকজনই এর শিকার হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে এ ধরনের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। বদ্ধ ট্যাংকে যে বিষাক্ত গ্যাস জমে থাকে- এ ধারণা না থাকা, ট্যাংকে পর্যাপ্ত অক্সিজেনের উপস্থিতি নিশ্চিত না করে এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষাব্যবস্থা না নিয়ে নামার জন্যই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। শ্রমিকের অজ্ঞতা এবং তাকে নিয়োগ দেওয়া মালিকের অজ্ঞতার সঙ্গে উদাসীনতা ট্যাংকে মৃত্যুর কারণ। বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি বিষয়ে শ্রমিকেরা অনেক সময় সচেতন থাকেন না। আবার নিয়োগকর্তাও শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেন না। সরকারি স্তরে সচেতনতামূলক প্রচার কর্মসূচি এবং নিয়োগকর্তা-মালিকের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ। তারা আরও জানান, সাধারণ কিছু নিয়ম মানলেই এই দুর্ঘটনা রোধ করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে সেপটিক ট্যাংক খোলার পরপরই ভেতরে না ঢোকা। নিজে ঢোকার আগে মোমবাতি বা লণ্ঠন জ্বালিয়ে ট্যাংকে ঢোকাতে হবে, যদি ওই আলো নিভে যায়, তবে মনে করতে হবে যে ট্যাংকে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঢোকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আরেকটি পদ্ধতি হলো, পানি দিয়ে পুরো ট্যাংক ভরে ফেলা। আবার ফ্যানের বাতাস বা ব্লোয়ার দিয়ে ট্যাংকে থাকা বিষাক্ত গ্যাসকে সহনীয় করে তোলা। কথা হচ্ছে যা-ই করা হোক না কেন, ট্যাংকে প্রবেশের আগে সেখানে অক্সিজেনের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়াটা জরুরি। এখন এই ‘নিশ্চিত’ টা কে নিশ্চিত করবে। সাধারণ শ্রমিক তো আর অক্সিজেন বুঝে না। এ জন্য নিয়োগকর্তাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সেফটিক ট্যাংকের নিরাপত্তার বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা চালাতে হবে। প্রয়োজনে সেফটিক ট্যাংকে শ্রমিক নামার আগে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পরীক্ষা করে তার পরই অনুমোদন দিতে হবে। আর এতে বেঁচে যাবে অনেক প্রাণ। দমকল বাহিনীর অপারেশন বিভাগের উপ-পরিচালক দিলীপ কুমার ঘোষ বলেন, সেপটিক ট্যাংক বা বদ্ধ যে কোনো কূপের বিপদ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষের ধারণা না থাকার ফলে মাঝে মধ্যে এসব ঘটনায় মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। একজন ঢোকার পর যখন তার সাড়াশব্দ না পাওয়া যায়, তখন তাকে বাঁচানোর জন্য আর একজন মানুষ ঢোকে, তখন তারাও বিপদে পড়ে।