বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী রাখতে অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে রপ্তানীর সম্প্রসারণ, পণ্যের বৈচিত্রায়ন, নতুন বাজারের সন্ধান, দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি, কৃত্রিম তš‘র পোশাকের উৎপাদন ও রপ্তানী বৃদ্ধি প্রভৃতিতে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
বাংলাদেশ রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) কর্তৃক আয়োজিত ‘সম-সাময়িক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চিত্র: বাংলাদেশের ইপিজেডের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ -শীর্ষক একটি সেমিনারে বক্তাগণ এই মন্তব্য করেন। করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জসমূহ তৈরি হয়েছে তা বিশ্লেষণপূর্বক উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে সৃষ্ট সুযোগকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় তার উপায় খুজতে বেপজা আজ (০৯/০২/২০২৩) এই সেমিনারের আয়োজন করে। বেপজার সদস্য (বিনিয়োগ উন্নয়ন) আলী রেজা মজিদ সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোঃ তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, আমেরিকা-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ, করোনা মহামারী, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রভৃতির মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানী বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তিনি বলেন, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরেও এই ধারা অব্যাহত রাখতে আমাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং একই সাথে রপ্তানী পণ্যের বৈচিত্রায়ন ও সম্প্রসারণে মনোযোগী হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, “আমাদের মোট রপ্তানীর প্রায় ৮৬% তৈরি পোশাক নির্ভর যার বাজার মূলত ইউরোপ, আমেরিকা। রপ্তানীর সম্প্রসারণে আমাদের মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এ জাতীয় অপ্রচলিত বাজারের সন্ধান করতে হবে।” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করছেন উল্লেখ করে তিনি পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিদেশি ক্রেতাদের সাথে দর কষাকষির আহ্বান জানান।
তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, শেখ হাসিনার সরকার বিনিয়োগ বান্ধব সরকার। দেশের বেসরকারী খাতকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি উল্লেখ করে বলেন, বেপজার নেতৃত্বে ইপিজেডের বিনিয়োগকারী ও অন্যান্য শিল্প উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করে সরকারের কাছে ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত কোন সমস্যা উত্থাপন করলে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার স্বার্থে তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করা হবে।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান, এনডিসি, পিএসসি সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, সারা বিশ্ব বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক চালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারীর জন্য কঠোর লকডাউনের পর চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেইসাথে অর্থনৈতিক পরাশক্তিদের অবরোধ-পাল্টা অবরোধ বিশ্বকে অর্থনৈতিক অ¯ি’রতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে। জ্বালানি সংকট, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি বিশ্ব বাণিজ্যকে মন্দার দিকে ধাবিত করেছে।” তিনি আরো বলেন, এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ঢেউ বাংলাদেশেও লেগেছে।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় এ অঞ্চলে অ¯ি’তিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর রপ্তানি চাহিদা কমে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, চলমান অর্থনৈতিক উত্থান-পতন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলি অন্বেষণ করাই এই সেমিনারের উদ্দেশ্য।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপ¯’াপন করেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, কয়েকটি বিষয় অর্থনীতির রাশ টেনে ধরতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে- বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য মন্দা, অস্থিতিশীল পণ্য মূল্য ও লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, দীর্ঘ জ্বালানী সংকট, আমেরিকা-চীন বাণিজ্য সংকট ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ভূ-রাজনৈতিক অ¯ি’রতা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক জোটসমূহের কার্যকারিতা হ্রাস প্রভৃতি। বাহ্যিক এইসব প্রভাবকের সাথে অভ্যন্তরীন বিষয়াদি যেমন মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ প্রভৃতি যুক্ত হয়ে দেশের অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, তিনি উল্লেখ করেন।
ড. রাজ্জাক স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, রপ্তানী বৃদ্ধি করতে আমাদের পণ্যের বৈচিত্রায়ন করতে হবে এবং প্রাকৃতিক তš‘র পোশোক ছাড়াও কৃত্রিম তš‘র পোশাক (ম্যান মেইড ফাইবার) উৎপাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানী সম্প্রসারণে ইপিজেডের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইপিজেডের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ আহরণের পাশাপাশি গ্লোবাল ভ্যালু চেইন সমন্বিতকরণ, অধিকতর কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তির আত্তীকরণ এবং আন্তর্জাতিক শিল্প স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন।
সেমিনারে প্যানেল বক্তা হিসেবে বাংলাদেশ ইপিজেড ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন (বেপজিয়া)-এর প্রেসিডেন্ট এস. এম. খান বর্তমান ব্যবসায়িক পরি¯ি’তি তুলে ধরেন। বিনিয়োগকারীগণ ব্যবসা পরিচালনায় যেসব সমস্যার সম্মুক্ষীণ হ”েছন এবং আগামী দিনগুলোতে যেসকল সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন সে বিষয়ে আলোচনা করেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক ইফতেখার আউয়াল ভূঁইয়া ব্যাংকিং সেক্টরে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গ্রহীত নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। জাতয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সদস্য হোসেন আহমদ করোনা মহামারী পরবর্তী অবস্থা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার তথা এনবিআর যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সে বিষয়ের উপর আলোচনা করেন এবং সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা সহজ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উন্মুক্ত আলোচনায় ইপিজেডের বিনিয়োগকারীগণ তাদের ব্যবসা পরিচালনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
সেমিনারে বিনিয়োগ ও রপ্তানি সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানেসমূহের প্রধানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ, বেপজাধীন ইপিজেডসমূহের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীগণ ও তাদের প্রতিনিধিবর্গ এবং বেপজার উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।