বাংলাদেশের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থেমে থেমে গোলাবর্ষণ চলছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলাবারুদে হতাহতের ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছে স্থানীয়রা। একের পর এক গোলাবর্ষণ ও হামলার ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে গতকাল সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফের তলব করা হয়। এ নিয়ে তাকে চাতুর্থবারের মতো তলব করা হলো।
অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অণু বিভাগের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নাজমুল হুদার দপ্তরে তলব করে সীমান্তে গোলাবারুদ বর্ষণ ও হামলার ঘটনায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়।
গতকাল রোববার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘মিয়ানমারকে কড়া জবাব দিয়েছে বিজিবি। কিন্তু মিয়ানমারের ঘটনায় শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় বাংলাদেশ। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে জাতিসংঘকে জানানো হবে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘তবে এই সুযোগে আর একজন রোহিঙ্গাকেও ঢুকতে দেয়া হবে না। বর্ডারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যথেষ্ট মনোবল নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে।’
এদিকে আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি এএইচ সেলিম উল্লাহ ও বান্দরবান প্রতিনিধি জমির উদ্দিন জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের পরিস্থিতি এখনো উন্নতি হয়নি। গতকাল রোববার সকাল থেকেও দিনভর মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থেমে থেমে গোলাবর্ষণ হচ্ছে। সীমান্তের আশপাশে কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। নিরাপত্তা টহল জোরদার করা হয়েছে।
স্থানীয় সিএনজিচালিত অটো রিকশাচালক রিদুয়ান বলেন, রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, তাই ভাড়াও নেই। তবুও পেটের দায়ে সড়কে বের হতে হয়েছে। তবে কখন মিয়ানমারের ছোড়া মর্টার শেল এসে তার মাথায় পড়ে সেই ভয়-আতঙ্ক নিয়ে সড়কে গাড়ি চালাচ্ছেন।
স্থানীয়রা জানান, ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্ত এলাকার নানা পেশার মানুষ এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ ও দিনরাত গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত স্থানীয়রা। গত প্রায় একমাস ধরে এভাবেই চলছে। জীবনযাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও গত শুক্রবার মর্টার শেল হামলায় রোহিঙ্গা কিশোর নিহত হওয়ার পর চরম আতঙ্ক ভর করেছে তাদের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ও কৃষক মাঠে যেতে এবং ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে ভয় পাচ্ছে সীমান্তে। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সীমান্তের মানুষের। ফলে থমথমে পরিস্থিতিতে অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে আছে সীমান্তের মানুষ।
স্থানীয় মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ইয়াছমিন পারভিন তিবিরিজী।
সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতিতে নাইক্ষ্যংড়ি উপজেলা প্রশাসন আতঙ্কিত সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া মানুষদের খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
গতকাল সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ইউএনও সালমা ফেরদৌস। বৈঠকে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিভিন্ন সুপারিশ লিখিত আকারে জেলা প্রশাসক বরাবরে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল চৌধুরী।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস বলেন, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হচ্ছে এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। তুমব্রু সীমান্তবাসীদের অভয় ও নিরাপত্তা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টারের একাধিক গোলা রাখাইনের ওয়ালিডং পাহাড়ের পাদদেশের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এসে পড়ে। এতে মো. ইকবাল নামে এক কিশোরের প্রাণ যায়। আহত হন আশ্রয়শিবিরের পাঁচজন।
ওই দিন বেলা ৩টার দিকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখার ৩৫ নম্বর পিলারের কাছাকাছি জায়গায় গরু আনতে গেলে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অথোয়াইং তঞ্চঙ্গ্যা (২২) নামে বাংলাদেশি এক তরুণের বাঁ পায়ের গোড়ালি উড়ে যায়। ঘুমধুমের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হেডম্যানপাড়ার বাসিন্দা ওই তরুণের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এদিকে শূন্যরেখায় আরও মাইন পোঁতা থাকতে পারে, এমন শঙ্কায় মাঠে যাচ্ছেন না কৃষকরা। গত শনিবারও সকাল সোয়া ৯টা থেকে রাখাইনের ওয়ালিডং পাহাড়ে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। এ অবস্থা চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। পরে গোলাগুলির আওয়াজের তীব্রতা কমে আসে। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা এ কথা জানিয়েছেন।
মিয়ানমার থেকে আসা গোলার বিস্ফোরণে রোহিঙ্গাদের হতাহতের ঘটনার পর শনিবার সকালে সীমান্ত এলাকায় মাইকিং করে বাসিন্দাদের নিরাপদ দূরত্বে থাকার নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন।
এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি গুলি তুমব্রু বাজারের পাশে কোনারপাড়ার কৃষক শাহজাহানের বাড়ির আঙিনায় এসে পড়ে। বাড়ির পাশেই শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। এর আগেও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা এসে পড়েছিল। এসব ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে একাধিকবার তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।