বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে রয়েছে ভগ্নপ্রায় চৌধুরী বাড়ি যা জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। উলানিয়া জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা সুবাদার হানিফ, যিনি ভারতীয় মুসলমান ছিলেন না। তার ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ শেখ মোহাম্মদ আসাদ আলী ভাগ্যান্বেষণে সুদূর পারস্য থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি প্রথমে অযোধ্যায় ও পরে মুর্শিদাবাদে বসতি স্থাপন করেন। মোহাম্মদ হানিফ সৈনিক বিভাগে চাকরি করতেন। পরে তিনি ওলন্দাজ দস্যু দল, মগ ও ফিরিঙ্গি দলকে বাকেরগঞ্জ জেলার সাগর উপকূল থেকে সমূলে উৎখাত করেন। পিশাচ প্রকৃতির দস্যুদলের পৈশাচিক তাণ্ডবে যে স্থান জনমানব শূন্য জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল, তা-ই আবার ধীরে ধীরে মোহাম্মদ হানিফের তত্ত্বাবধানে জনবহুল হয়ে উঠল। সুবাদার হানিফের এই বীরত্বপূর্ণ কাজের ফলস্বরূপ তাঁর পরবর্তী বংশধর এই ভূখণ্ডের জমিদার পদে অধিষ্ঠিত হন। শত বছরের উলানিয়া জমিদার বাড়ি ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয় বাকলা তথা চন্দ্রদ্বীপের এই অঞ্চলটা এককালের পূর্তুগীজ-আরাকন-ফিরিঙ্গী-বর্গী-মগ জলদস্যুদের অভয়ারন্য ছিল। বিভিন্ন সময় এসব জলদস্যুদের মুঘল সেনাপতি শাহাবাজ খাঁ, আগা মেহেদী প্রমুখ তাদের পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী নিয়ে অভিযান চালায়। এই অঞ্চলের পূর্ববর্তী নাম শাহাবাজপুর এবং বর্তমান নাম মেহেন্দিগঞ্জ তাদের স্মৃতি এবং বিজয় স্মারক। ধারাবাহিকতায় উত্তর শাহাবাজপুর তথা আজকের মেহেন্দিগঞ্জ-হিজলা অঞ্চলে অবস্থান নেয়া হার্মাদ-মগ-বর্গী দস্যুদের বিতাড়িত করতে মুঘলদের স্থাপিত সংগ্রাম কেল্লায় (সম্ভবত আগা মেহেদীর সময়ে স্থাপিতঃ বর্তমান ভোলা জেলার অর্ন্তগত রামদাসপুর গ্রামে অবস্থিত সংগ্রাম কেল্লাটি আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়) অবস্থান করেণ শায়েস্তা খাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি শেখ মোহাম্মদ হানিফ। তিনি স্থানীয়দের সহযোতিায় তার সৈনিকদের নিয়ে হার্মাদ-মগ-বর্গীদের আক্রমন করেন। পরপর আক্রমনে এসব দস্যুরা চিরতরে নিস্তেজ হয়ে যায়। বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ শায়েস্ত খাঁ শেখ মুহাম্মদ হানিফকে সংগ্রাম কেল্লা এবং অঞ্চলের সুবেদার নিয়োগ করেন। শেখ হানিফ সংগ্রাম কেল্লা থেকে একটু দূরে সরে কালিগঞ্জের কাছাকাছি উলুবন আবাদ করে বসতি স্থাপন করে। এই উলুবনই পরবর্তীতে উলানিয়া নামে প্রসিদ্ধ হয়। উলানিয়া জমিদার বাড়ি নিয়ে নানা গল্প লোকমুখে শোনা যায়। ইতিহাসবিদ সিরাজ উদদীন আহমেদ তার লেখা বরিশাল বিভাগের ইতিহাস বইতে লিখেছেন, উলানিয়ার জনৈক জমিদার বিদ্রোহের অভিযোগে চানপুরের আছু আখনকে ফুটন্ত গরম তেলে জ্বাল দিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেন। ছবিতে দেয়া দ্বিতল ভবনটির নিচতলায় একটি অন্ধকার কূপ ছিল। এটিকে স্থানীয় ভাষায় আন্ধার কোডা বলা হয়ে থাকে। প্রচলিত রয়েছে যে জমিদাররা তাদের বিরুদ্ধচারণকারীদের এ অন্ধকার কূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করতো। এসব কিছুকে ছাড়িয়ে উলানিয়া জমিদার বাড়ি মর্যাদার আসন করে নিয়েছে অসংখ্য সূর্য সন্তানের জন্ম দিয়ে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি- এ অমর গানের রচয়িতা, প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী, তার সন্তান বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিয়াজুর রহমান চৌধুরী, একুশে পদকপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি আসাদ চৌধুরী, ভাষা সৈনিক মরহুম বাহাউদ্দিন চৌধুরী, বরিশালের সাবেক গভর্নর আমিনুল হক চৌধুরী, প্রখ্যাত নাট্যকার মরহুম আতিকুল হক চৌধুরী, সোহরাব-রুস্তুমের রচয়িতা, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের জামাতা মরহুম মৌলভী বজলুর রহিম চৌধুরী, কালা পাহাড়ের রচয়িতা নুরুল হক চৌধুরী, দীপ্ত টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও আমিনুল হক চৌধুরীর সন্তান ফুয়াদ চৌধুরী।