করোনা ও আর্থিক দৈন্যতার কারণে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর, আরজিশাহপুর ও শক্তিপুর গ্রামের অন্তত্য শতাধিক পরিবার এখনো মৃৎশিল্প ও নানা খেলনা তৈরির কাজে নিয়োজিত আছেন। পালপাড়ার হাজার বছরের ঐতিহ্য মৃৎশিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে। গেলো সপ্তাহে কোচাশহর পালপাড়ার মৃৎ শিল্পীদের সাথে কথা বলে জানা যায়,বর্তমানে শিল্পের সাথে পরিবার গুলো আর্থিক সমস্যায় রয়েছে। আমাদের মৃৎশিল্প এলাকার বিভিন্ন হাটে-বাজারে, মেলায়, পূজা অনুষ্ঠানে প্রচুর বিক্রি হত। গত ২৫ মার্চের পর হতে করোনার করাল থাবায় হাট-বাজারসহ পার্বণ-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমাদের মৃৎশিল্প বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা চরম আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
তাঁরা আরো বলেন, হাজার বছরের ঐতিহ্য এই পালপাড়ায় বর্তমানে প্রায় শতাধিক পরিবার মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। উৎপাদিত মৃৎশিল্পের আয় হতে আমাদের সংসারের ব্যয় ও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ নির্বাহ হতো। কিন্তু করোনাকালীন আমাদের সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। এমনকী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২৫০০ টাকার প্রণোদনাসহ সরকারি কোনো ত্রাণ বা অনুদান ১০/১৫ জন ছাড়া পালপাড়ার আর কেউ পায়নি। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, কোনো সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি কিংবা কোনো বিত্তবান ব্যক্তির নিকট হতে কোনো সাহায্য পাইনি। বর্তমানে আমরা করোনার করাল গ্রাসে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে এবং মৃৎশিল্পের কাচামাল সংগ্রহ করতে নাজেহাল হয়ে পড়েছি। আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগে আমাদের আশে পাশে এলাকায় এঁটেল মাটি পাওয়া যেত। এখন কোনো জমি অনাবাদী না থাকার কারণে মৃৎশিল্পের জন্য মাটি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্য এলাকা হতে অনেক ব্যয়ের পর মাটি সংগ্রহ করে মৃৎশিল্প তৈরি করতে হয়। তারপরও আগের মতো বাজারে বিক্রি হয় না। বর্তমানে প্রতিটি বাড়িতে প্লাস্টিক, এ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের দ্রব্যাদির ব্যবহার বেশি হওয়ায় মৃৎশিল্পের দ্রব্যাদির চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে পালপাড়ার মৃৎ শিল্প কারিগররা অন্যান্য বিভিন্ন পেশায় ঝুঁকে পড়ছে। পালপাড়ার কয়েকজন বলেন, এই মৃৎশিল্প রক্ষার জন্য সরকারি কোনো সহযোগিতা বা সহজ শর্তে ঋণ পেলে আমরা উপকৃত হতাম। বিভিন্ন এনজিও সংস্থা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঋণ দিচ্ছে কিন্তু কিস্তি ও সুদের টাকা পরিশোধ করতে অনেক সময় গরু ছাগলও বিক্রি করতে হচ্ছে। পালপাড়ার শতাধিক পরিবারের মৃৎশিল্পকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।কিন্তু কোচাশহর ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠিত পালেরা মৃৎশিল্প উৎপাদন ছাড়া অন্যকোনো পেশায় জড়িত নয়। তারা মাটির হাঁড়ি-পাতিল, মাটির রিং, হীরা, কলস, মাটির কাঁসা, কাদা, ফুলের টব, রঙিন মাটির পাতিল, দিয়াড়ি, মাটির কুপি, মাটির থালাসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি তৈরি করে সংসার চালাতেন। এই পালপাড়ার মাত্র কয়েক জন যুবক সরকারি চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সরকার আমাদের দিকে সু-নজর দিলে পালপাড়ার পরিবারগুলো উপকৃত হতো। রক্ষা পেত মৃৎশিল্প। তাদের এই পত্রিক পেশাকে শত প্রতিকুলতার মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছেন অনেক মৃৎশিল্পী পরিবার। তবে আর্থিকভাবে কখনোই স্বচ্ছল ছিলেন না তাদের বেশিরভাগই। পহেলা বৈশাখ যেন এ সব পরিবারে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। হরেক রকম বাহারি তৈজসপত্র তৈরি হতে থাকে পালপাড়ায়। গনগনে আগুনের চুলোর তাপে ঘাম ঝরে কুমোরের। রঙ-তুলির আঁচড়ে নানা রূপ নেয় মাটির তৈজসপত্র ও খেলনা সামগ্রী। বাঁশের ঝুঁড়িতে সাজিয়ে গ্রামের মেলায় ছুটে বেড়ান এসব পরিবারের কর্তা-ছেলেরা। লক্ষ্য একটু আর্থিক স্বচ্ছলতা। কিন্তু করোনার প্রভাবে সব স্বপ্ন মিশে গেছে মাটিতে। বন্ধ রয়েছে অনেকে চুলো, স্তপ আকারে পরে আছে মাটি। রঙ-তুলির আঁচড় পড়েনি তৈরি করা কিছু তৈজসপত্রেও। মেলা বন্ধ, বিক্রি বন্ধ। এই আর্থিক ক্ষতি আদৌ কাটিয়ে উঠতে পারবে কি না জানা নেই তারা। সারা বছর কাজ করার মতো পুঁজি না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে বড় কষ্টে দিন কাটে। শুধু ঈদ পুঁজো বা বৈশাখী মেলার আয় দিয়ে পেট ভরে না। তাই অনেকেই পেশা পরিবর্তনের কথা ভাবছেন।