ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ঘিরে আগে থেকেই বাড়তি সতর্ক বার্তা দিচ্ছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। রাজধানীতে মশা নিয়ন্ত্রণের বড় দায়িত্ব পালন করে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সংস্থা দুটি বলছে, বছরের শুরু থেকেই মশা নিধনে কার্যক্রম চলমান। পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে রাজধানীর প্রত্যেক এলাকায় প্রচারণাও চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছর মশা নিধন কার্যক্রমে উত্তর সিটি কর্ম পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে, তবে দক্ষিণে চলছে আগের কার্যক্রমই। গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে বলা হয়, এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৫ মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১ হাজার ৮০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় ৫৮৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৯২ জন। একই সময়ে দেশে মোট ছাড়প্রাপ্ত ডেঙ্গু রোগী ৯৮৪ জন। এরমধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগী ৫১২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৭২ জন রয়েছেন। এছাড়াও চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মোট ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণত বর্ষাকালেই ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার বিস্তার হয়ে থাকে। তবে বছরের শুরু থেকেই মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চলমান রেখেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এ বছর মশা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমাতে পূর্বের কার্যক্রমের কিছু পরিবর্তন এনেছে, সঙ্গে নতুন কিছু পদ্ধতি প্রয়োগের কথাও জানিয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি থেকে বলা হয়, মশা নিয়ন্ত্রণে ফগিংয়ের (ধোঁয়ার মাধ্যমে মশা নিয়ন্ত্রণ) চাইতে লার্ভিসাইডিং (লার্ভা ধ্বংস) বেশি কার্যকর। তাই এ বছর লার্ভিসাইডিংয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ডিএনসিসি। এছাড়া লার্ভিসাইডিং প্রয়োগের সময়েও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে সকাল ৮টা থেকে ১১টার সময়ে পরিবর্তন এনে বর্তমানে ভোর ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলবে লার্ভিসাইডিং। এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের মেয়র মহোদয় যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি ভিজিট করেছেন, সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব উপায় দেখেছেন; যা আমাদের এখানে নেই। সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। যেমন আমরা লার্ভিসাইডিং আর ফগিংকে সমান গুরুত্ব দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু সেখানে ফগিংটাকে কম গুরুত্ব দিয়ে লার্ভিসাইডিংকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই আমরা আমাদের কীটবিদের পরামর্শে লার্ভিসাইডিংয়ের সময় পরিবর্তন করে সকাল ৮টার বদলে ভোর ৬টা থেকে শুরু করেছি। কেননা, সূর্যের উত্তাপ যত বাড়ে লার্ভাগুলো পানির নিচে চলে যায়, তাতে ওপরে লার্ভিসাইডিং করলে কার্যকারিতা পাওয়া যায় না।’ এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত বেসিলাস থারিংগেসিস সাবস্পেসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই) টুল প্রয়োগ করতে যাচ্ছে ডিএনসিসি। এ বিষয়ে ডিএনসিসির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের মেয়র মহোদয় যুক্তরাষ্ট্রে মশা নিধনে আরেকটা বিষয় দেখেছেন, বিটিআই পদ্ধতি। এটার কার্যকারিতা নিয়ে কীটবিদের কোনও সন্দেহ নেই। কেননা, এটা বায়োলজিক্যালি মশা কন্ট্রোল করে, এতে পরিবেশেরও কোনও ক্ষতি হয় না। আমরা সেটাকে ইতোমধ্যে কেনার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আছি। ইতোমধ্যে আমরা ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করিয়েছি এবং ভালো রেজাল্ট পেয়েছি। এখন এটা আমরা মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করবো।’ এছাড়া ডেঙ্গুর লার্ভা ধ্বংসে এলাকাগুলোর জলাশয় ও ড্রেনে গাপটি মাছও ছাড়া হচ্ছে বলে জানান ডিএনসিসির এই কর্মকর্তা। সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণাতেও কিছুটা পরিবর্তন এনেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এখন যারা সকালে মশা নিধনে ওষুধ প্রয়োগ করবেন, তারাই প্রচারণাও করবেন বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রচার-প্রচারণার প্রতি আমরা বেশি জোর দিয়েছি। আগে যেটা মাইক ভাড়া করে রিকশায় রিকশায় মাইকিং করাতাম, সেটার বদলে এখন প্রত্যেক ওয়ার্ডের জন্য হ্যান্ডমাইক কিনে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সকালে যেখানে যখন স্প্রে করা হচ্ছে, সেখানে একই সময়ে মাইকিংও করা হচ্ছে। তারাই আবার লিফলেটও বিতরণ করছেন।’ অপরদিকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও বেশ তৎপর রয়েছে। তবে আগের পদ্ধতিতেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বেশি জোর দিয়েছে বলে জানিয়েছি সংস্থাটি। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অ. দা.) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ‘আমরা বছরের শুরু থেকেই মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিয়ে আসছি। আমাদের ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম, যেটা সকালে লার্ভিসাইডিং আর বিকালে ফগিং করা হচ্ছে। এছাড়া আমরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে, বিভিন্ন অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি।’ রাজধানীবাসীর সচেতনতাই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে মন্তব্য করে ডিএসসিসির এই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘ডেঙ্গু এমন একটি বিষয় এটা কিন্তু শুধু মশার ওষুধ ছিটিয়ে নির্মূল করা সম্ভব না। এখানে মানুষের বাসাবাড়িতে ও এর আশপাশে পানি জমে থাকে সেখানে ডেঙ্গু হয়। কাজেই মানুষকে সচেতন হতে হবে যে আমরা কেউ কারও বাড়িঘর, অফিস-প্রতিষ্ঠানে কোনও পানি জমতে দিবো না। তাহলে কিন্তু আমরা ডেঙ্গু থেকে মুক্ত হতে পারি।’ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নতুন কোন পদ্ধতি ব্যবহার করবে কিনা জানতে চাইলে ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, আমাদের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে কীটতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের একটি কমিটি রয়েছে। তারা ঠিক করেন কীভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তবে আমাদের চলমান পদ্ধতি ভালোভাবেই কাজ করছে। চলমান ফগিং ও লার্ভিসাইডিং পদ্ধতির কোনটি বেশি গুরুত্ব দিবে ডিএসসিসি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘গত ৩০ বছর ধরেই জানা, ফগিংয়ের চাইতে লার্ভিসাইডিং বেশি কার্যকর। এটা নতুন করে কিছু বলার নেই। কেননা, এটা মশার লার্ভাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ফলে মশার নতুন করে বংশবিস্তারের সুযোগ থাকে না। আমরা বরাবরই লার্ভিসাইডিংয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছি। এবারও তাই হবে।’