ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের সংবাদপত্র ও প্রকাশনা শিল্প। কারণ আকস্মিকভাবেই মাত্রাতিরিক্ত দাম বেড়েছে কাগজের। প্রতি টনে কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। শিক্ষার্থীদের খাতা হিসেবে যেমন কাগজের ব্যবহার রয়েছে তেমনই আবার বই ও সংবাদপত্র ছাপতেও প্রয়োজন কাগজের। কিন্তু এসবের অন্যতম এই উপকরণের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। মাত্র পাঁচ মাসেই পাইকারিতে প্রতি টনে দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। এতে বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থী ও প্রকাশনা শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
পাইকারি বাজারে শুধু যে কাগজের দাম বেড়েছে তা নয়। বেড়েছে মলাটের কাগজের দামও। গত এক সপ্তাহে প্রতি ১০০ মলাটের কাগজের দাম এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে দুই হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। একই পরিমাণ আর্ট কার্ডের দামও এখন ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি। ১০০ আর্ট কার্ড মিলছে তিন হাজার ৫০০ টাকায়। এক রিম রঙিন কাগজের দাম ৮৫০ টাকা থেকে বেড়ে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। পাইকারি বাজারে কলম তৈরির প্লাস্টিকের প্রতি ২৫ কেজি বস্তার দাম তিন হাজার ৮০০ টাকা থেকে বেড়ে চার হাজার ৪০০ টাকা হয়েছে। কাগজসংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপকরণের দামও বাড়তি। পাইকারিতে এক সপ্তাহ আগেও ১২০ পৃষ্ঠার এক ডজন খাতা বিক্রি হয়েছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়। এখন তা ৪০০ টাকায় কিনতে হয়।
তথ্য মতে, বাংলাদেশে মোট ২০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এরমধ্যে চলমান ৭০ থেকে ৭৫টি। বাকি মিল নানা সংকটের কারণে এখন আর উৎপাদনে নেই। দুই দশক আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেসরকারি খাতের মিল মালিকরা একচেটিয়া বাণিজ্য করার সুযোগ নিচ্ছেন। নানা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সপ্তায় সপ্তায় বাড়ানো হচ্ছে কাগজের দাম। অন্যদিকে এতে দৃষ্টি দেওয়ারও কেউ নেই। ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে সংবাদপত্র ও প্রকাশনা শিল্পের ভবিষ্যৎ। কাগজ সংকটের কারণ হিসেবে জানা গেছে, দেশীয় শিল্প বিকাশে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি প্রিন্টিং হোয়াইট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট আমদানির তেমন সুযোগ নেই। তবে কাগজ তৈরির প্রধান উপকরণ পাল্প আমদানি করতে হয়। তবে নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনে ব্যবহৃত পাল্প দেশীয় পুরোনো কাগজ রিসাইক্লিন করে পাওয়া গেলেও সাদা কাগজ উৎপাদনে পাল্প আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে পাল্প আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে এলসি খুলতে পারছেন না আমদানিকারকরা। এ ছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে যেসব মিলের প্রতিদিন ৫০০ টন কাগজ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে সেগুলো এখন ৭০ থেকে ৮০ টনের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।
আবদুল কাইয়ুম নামে এক মুদ্রণ ব্যবসায়ী বলেন, গত কয়েক মাসে কাগজের দাম অনেক বেড়েছে। প্রত্যেক সপ্তাহে দাম বাড়ে। যে খাতা ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় কেনা যেত তা এখন ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। ২৮০ টাকার রিম এখন প্রায় ৪০০ টাকা। রাজধানীর চকবাজারের পুস্তক প্রকাশক মিয়া রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘কাগজের দাম টনপ্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আগে কাগজের মূল্য ছিল ৯৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। নিউজপ্রিন্ট কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকায়। যা কয়েক মাস আগেও কিনেছি ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকায়।’
বর্তমান সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই তুলে দেওয়া। কাগজের বাজারে অস্থিরতার কারণে সেটিও অনেকটা শঙ্কার মুখে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে দেরিতে কাজ পাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়া ও বিদ্যুৎ-বিভ্রাটসহ নানা চ্যালেঞ্জের কথা বলছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের জন্য এবার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৩ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৯৮ লাখ ৫৩ হাজার কপি এবং মাধ্যমিক স্তরের জন্য ২৪ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার কপি পাঠ্যবই ছাপানো হবে।
মুদ্রাকররা জানিয়েছেন, প্রাথমিক স্তর এবং মাধ্যমিক স্তরের চার রঙের বই ছাপা হয় ৮০ জিএসএম কাগজে। আর মাধ্যমিকের এক রঙের বই ছাপানো হয় ৬০ জিএসএম কাগজে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া যখন চলছিল তখন বাজারে এ মানের কাগজের দর ছিল প্রতি টনে ৫০ হাজার টাকা। এখন দাম বেড়েছে প্রায় দেড় থেকে দ্বিগুণ। দরবৃদ্ধির কারণে বেঁকে বসেছেন মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বাজারে চলমান দাম অনুযায়ী তাদের টাকা দিতে হবে-তা না হলে তারা বই ছাপাতে পারবেন না।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে এখন যে পরিমাণ কাগজ আছে তাতে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পাঠ্যবই ছাপানো সম্ভব হবে। পাঠ্যবইয়ের কাগজ উৎপাদন করে তিনটি পেপার মিল। তাদের কাছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টন কাগজ উৎপাদনের পাল্প আছে। ৩৫ কোটি বই ছাপাতে লাগবে এক লাখ টনেরও বেশি কাগজ। এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থে বিদেশ থেকে কাগজ বা ভার্জিন পাল্প শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমতি দেওয়া।’
অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির একুশে বইমেলা সামনে রেখে উদ্বেগ বাড়ছে প্রকাশকদের মধ্যে। এ অবস্থায় কাগজের আমদানি, দেশীয় উৎপাদন ও সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা এবং এ খাত নিয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধের ওপর নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নবচেতনা / এমএআর