দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। চিকিৎসাধীন অবস্থায় যাদের একটি বড় অংশের মধ্যে শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের জন্য হাহাকার চলছে। কোথাও সিট খালি নেই। একটা আইসিইউ বেড যেন সোনার হরিণ।
আইসিইউ সাপোর্টের অভাবে রোগীদের আর্তনাদ বাড়ছে। দেশে করোনার সংক্রমণ যখন উদ্বেগজনক ছিল, সেই সময় আইসিইউ শয্যা নিয়ে যেমন হাহাকার ছিল, তেমন চিত্র আবারও ফিরে এসেছে। নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র ফাঁকা না পেয়ে রোগী নিয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে স্বজনদের। আইসিইউ বেডের জন্য রোগীদের নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন স্বজনেরা। এমনকি সংবাদপত্র অফিসে ফোন করে আইসিইউর ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন অনেকে। ইত্তেফাকে প্রতিদিন চার-পাঁচটি এমন ফোন আসে। সাধারণ মানুষের এই আর্তিতে বিব্রত হন চিকিৎসকেরা। কেবল চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তাদের। আইসিইউ শয্যা না পেয়ে স্বজনেরা রিস্ক বন্ডে সই করে সাধারণ ওয়ার্ডে সেবা দিতে বাধ্য হচ্ছেন গুরুতর মুমূর্ষু রোগীর।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু রোগীদের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। যথাসময়ে আইসিইউ না পাওয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের মৃত্যুর হার বাড়ছে। যে রোগীর আইসিইউ প্রয়োজন, তাকে আইসিইউতেই রাখতে হবে। কিন্তু এখন আইসিইউ বেড খালি নেই। করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য খাতে এই আইসিইউ বেডের ঘাটতির বিষয়টি। কিন্তু তার পরও অনেক জেলা-উপজেলায় এখনো আইসিইউ নেই। এতে গ্রামের মানুষ সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি হাসপাতালে আইসিইউর মান ভালো আছে। যদিও অনেক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ নিম্নমানের। আইসিইউর যে ব্যবস্থাপনা সেখানে থাকা দরকার, তা নেই। আইসিইউ বেডের রেটও সেখানে অনেক বেশি।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এ বছর এক দিনে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর এক দিনে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬১তে। গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪০ হাজার ৯৮৩ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ২৭ হাজার ৬৪৬ জন এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে ১৩ হাজার ৩৩৭ জন। এটা সরকারি হিসাব। বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি। ডেঙ্গু বাড়লেও মশা নিধনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনও পৌরসভা আছে, যেখানে জীবনে মশা মারার এক ফোঁটা ওষুধও ছিটানো হয়নি। রাজধানীতে এখন প্রচুর মশা। নিন্দুকেরা বলেন, মশা বাড়লে সিটি করপোরেশনের একশ্রেণির কর্মকর্তার লাভই হয়। কারণ তারা নানা জিনিসপত্র কিনতে পারেন। এক্ষেত্রে নিম্নমানের জিনিসপত্র কিনে মোটা অঙ্কের টাকা তারা পকেটে ভরেন।
স্বাস্থ্য প্রশাসন বলছে, দেশের ৫০ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেশের সব জেলা-উপজেলায় ডেঙ্গু রোগী রয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত অর্ধশতাধিক রোগী বলেন, গল্প শুনিয়ে লাভ নেই, মশা নিধনে অ্যাকশন চাই। একই সঙ্গে যেসব বাসায় ডেঙ্গুর উৎপত্তিস্থল পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানা করতে হবে।
ডেঙ্গুকে দৃশ্যমান শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গু মশাবাহিত একটি রোগ। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে হলে এডিস মশা নিধন করতে হবে। মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে। এক্ষেত্রে অবহেলা করা হলে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, আগে মে-অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু হতো, এখন ১২ মাস ডেঙ্গু হয়। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। সেই বছর আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়ালেও ২০২০ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা কম ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, সাধারণত আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখন সারা বছর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আগে শুধু রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যেত, এখন ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যে জিনিস দিয়ে ডেঙ্গু হয়, সেই শত্রু শনাক্ত হয়েছে। এর প্রতিকার ও প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। মশা মারতেই হবে। বাসায় জমাট পানি যেন না থাকে। আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা সচেতন হলেই তারা নিজেদের বাঁচাতে পারে। এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক প্রচারও চালাতে হবে।
তিনি বলেন, আইসিইউর চিকিৎসা আইসিইউ দিয়েই করতে হবে। আইসিইউ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। তবে উপজেলা পর্যন্ত আইসিইউ থাকা উচিত। ডেঙ্গু রোগী শকে চলে গেলে তাদের বেশির ভাগ মারা যায়। আইসিইউ এজন্য খুব জরুরি। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ খাওয়া যাবে না। তরলজাতীয় খাবার খেতে হবে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, সারা দেশে নতুন করে আরও ১ হাজার ২০০ আইসিইউ বেড তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ইউনিসেফ, ইউএসআইডি মেশিনগুলো আনছে। এটা বিশ্বব্যাংকের একটি বড় প্রকল্প। ৪৩টি জেলা সদর হাসপাতালে ১০টা করে আইসিইউ বেড, ৩৭টি নতুন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০টা করে আইসিইউ বেড স্থাপন করা হবে। সেখানে লিকুইড অক্সিজেনসহ আধুনিক ব্যবস্থাপনা থাকবে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা ও জেনারেটরও থাকবে।
অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডাক্তাররা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। এ সময় ডাক্তাররা বলেন, ‘কোভিড আমাদের অনেক কিছু দেখিয়ে দিয়েছে। সামনে আরও নানা রোগ আসতে পারে। তাই আইসিইউ বেড বাড়াতে হবে।’ পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইসিইউ বেড বাড়ানোর নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীরা শকে গেলে অধিকাংশ মারা যায়। তবে শকে যাওয়ার আগে আইসিইউ সাপোর্ট পেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। জেলা-উপজেলায় আইসিইউ নেই, তাই সেই সুযোগ থেকে রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছে। ৪৩ জেলা সদর হাসপাতালের ১৬ জন ডাক্তার ও ১৬ জন নার্সকে আইসিইউ ম্যানেজমেন্ট সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সরকারি ১৬টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও সমসংখ্যক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বাকি আছে আরও সাতটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। শিগগিরই তাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।