বাংলাদেশের ওষুধশিল্প সম্পর্কে ধারণা পাওয়াটা সহজ, আবার কঠিনও বটে। দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে পাওয়া বিধিমালা এবং কিছু তথ্যের মাধ্যমে এ ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যাপারটা ঘোলাটে হয়ে পড়ে যখন আমি ওষুধশিল্প সংস্থাগুলোর নির্বাহীদের সঙ্গে আলোচনা করি এবং তাদের কারখানাগুলো পরিদর্শন করি।
কারখানা ভবন, সরঞ্জাম ইত্যাদি ঝকঝকে- সর্বোপরি তারা নিজেরাও পেশাদার। তারা যখন বোঝান যে তাদের উৎপাদিত ওষুধ নিরাপদ, কার্যকর ও উন্নতমানের, তখন তা অবিশ্বাস করা কঠিন। সরকারি ওষুধ বিধিমালায় যেমন কিছু বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য নেই, তেমনি সে তথ্যগুলো ওষুধ প্রস্তুতকারী শিল্পপতিরাও এড়িয়ে যান।
দেশে প্রথম ওষুধনীতি গৃহীত হয় ১৯৮২ সালে। এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রস্তাবিত অপরিহার্য ওষুধ জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে সরবরাহ করা এবং স্থানীয়ভাবে ওষুধ উৎপাদন শিল্প গড়ে তোলায় উৎসাহ দেয়া। সন্দেহ নেই, উদ্দেশ্যটি ভালো ছিল এবং এর ফলে দেশের ওষুধশিল্প উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করে।
পাশাপাশি, অপরিহার্য ওষুধগুলো সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহে সক্ষম হয়। এরপর ২০০৫ ও ২০১৬ সালে আরও দুটি ওষুধ নীতি গ্রহণ করা হয়, যার ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান এবং সামগ্রিকভাবে ওষুধশিল্পের জন্য মঙ্গলজনক। দেশে এখন প্রায় ২৫০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ছোট একটি দেশের তুলনায় এ বিশাল সংখ্যার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু, তা বিবেচনার বিষয়।
একটি দেশের ওষুধনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা ও উন্নতি নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশের ওষুধ নীতিমালার লক্ষ্য মূলত ওষুধশিল্পের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। কেউ দাবি করতে পারেন, এ ওষুধ নীতিমালার ফলেই সর্বাধিক প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু নীতি ও বিধিমালার ফাঁকফোকরে অবস্থান নিয়েছেন মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। এ নীতি ও বিধিমালা তৈরিতে তাদেরও যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
অপরিহার্য ওষুধকে সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ওষুধের কার্যকর উপাদান বা কাঁচামালের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। একইভাবে বাজারজাতকরণের জন্য উৎপাদিত অপরিহার্য ওষুধের সর্বোচ্চ মূল্যও নির্ধারিত আছে।
তৈরি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়াটা একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে খোলাবাজারে ঢুকতে এবং বাজারে তার অবস্থান দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেহেতু ওষুধের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা আছে, তাই লাভ যেন হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করার ব্যাপারেও উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
ফলে উৎপাদনকারীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ওষুধ উৎপাদন খরচ কমিয়ে লাভের সূচক বাড়াতে সচেষ্ট থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নীতি বিসর্জন এবং উৎপাদনের একটি বড় খরচ কাঁচামালের পেছনে ব্যয় হওয়ার কারণে ঘটতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়।
দেশে ওষুধের বেশিরভাগ কাঁচামাল আমদানি হয় ভারত বা চীন থেকে। প্রশ্ন আসতে পারে, সরকারনির্ধারিত দামে নিরাপদ, কার্যকর ও ভালো মানের ওষুধের কাঁচামাল কেনা সম্ভব কিনা? ভারত ও চীনের প্রস্তুতকারীরা যে দামে উন্নত দেশে কাঁচামাল সরবরাহ করে, বাংলাদেশেও কি একই দামে তা করে থাকে?
যদি একই কাঁচামাল কম দামে বাংলাদেশে রফতানি করা হয়, তাহলে এর পেছনে রহস্য কী? এ প্রক্রিয়ায় অনিরাপদ, অকার্যকর ও নিম্নমানের কাঁচামালে তৈরি ওষুধগুলো অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে, নাকি আরও অসুস্থ করে তুলছে? এসব প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক।
দেশে উৎপাদিত ওষুধ পশ্চিমা দেশগুলোতে অনুমোদিত ওষুধের জেনেরিক সংস্করণ, তবে কোনো প্রমাণ ছাড়া। ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আইন থেকে মুক্ত থাকবে। ফলে দেশের স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো পশ্চিমা দেশে কোনো ওষুধ উদ্ভাবন হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার অনুলিপি উৎপাদন করতে পারবে।
কিন্তু কোনো দেশ ওষুধ তৈরি করলে নিয়ম হল ওষুধগুলো যে দেশে উদ্ভাবিত, সেদেশের ওষুধের মতো একই রকমভাবে মানুষের শরীরে ঠিকমতো ঢুকছে কিনা, শরীরের ঠিক জায়গামতো পৌঁছাচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করার জন্য উদ্ভাবকদের ওষুধগুলোর সঙ্গে বায়ো-ইকুইভ্যালেন্সি পরীক্ষা করা। এ পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য।
কিন্তু বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসনের কাছে নিবন্ধন করতে গেলে বায়ো-ইকুইভ্যালেন্সি পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। বায়ো-ইকুইভ্যালেন্সি প্রমাণের অভাবে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধগুলো নিরাপদ বা কার্যকর এমন নিশ্চয়তাও থাকে না।
ওষুধ বিতরণ ব্যবস্থা : দেশে ফার্মেসি শিক্ষা চালু হয়েছে পাঁচ দশক আগে। কিন্তু এখনও ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। একজন ফার্মাসিস্টের প্রাথমিক ভূমিকা হল চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রোগীকে ঠিকমতো ওষুধ দেয়া। এটি দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্যসেবায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দেশে ফার্মেসিগুলো বি-গ্রেডের ফার্মাসিস্টদের দ্বারা চালিত হয়, যাদের শিক্ষা এবং ওষুধ সম্পর্কে জ্ঞান অপ্রতুল। ফার্মেসিগুলোতে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ বিক্রি হয়। এটা নিশ্চিত, অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ বিতরণ বহু মানুষের প্রাণহানিসহ ব্যাপক স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় ঘটাতে পারে। এতদসত্ত্বেও দেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগই গৃহীত হয়নি। কারণটা অনুমেয়- ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোকে লাভবান করাই এর উদ্দেশ্য।
ওষুধ তৈরি একটি উন্নত বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান সবসময় প্রমাণের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। ওষুধের মান, কার্যকারিতা এবং তা মানুষের ব্যবহারের জন্য নিরাপদ- এ বিষয়গুলো প্রমাণিত না হলে সেটা বিজ্ঞান হয় না, তৈরি হয় না প্রকৃত ওষুধও।
সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে, চিকিৎসকরা তাদের সঠিক ওষুধগুলো নির্বাচন করে দেবেন এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো তাদের কার্যকর, নিরাপদ ও মানসম্পন্ন ওষুধ সরবরাহ করবে। সুতরাং চিকিৎসক, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি এবং ওষুধ সরবরাহকারী ফার্মাসিস্টদের অবশ্যই সর্বোচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখতে হবে। কারণ জনস্বাস্থ্য এবং রোগীদের জীবন-মৃত্যু তাদের সততার ওপর নির্ভরশীল।
জনগণের উচিত ওষুধ নীতি ও বিধিমালাগুলো আবার তৈরি এবং তার আপসহীন বাস্তবায়নের দাবি করা। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি থাকতে হবে, যেটি বর্তমান নীতিমালা ও বিধিমালাগুলোর গলদ, সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি শনাক্ত ও পর্যালোচনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষায় একটি বিস্তারিত বিধিমালা প্রণয়ন করবে। দেশে ফার্মাসিস্টের পেশাকেও সংজ্ঞায়িত করতে হবে।
আরও একটি কমিটি থাকবে, যেটি ওষুধ সরবরাহ ব্যবস্থা প্রণয়ন করবে। এ ব্যবস্থায় স্নাতক ফার্মাসিস্টরা (বি.ফারম/ফারম.ডি) ওষুধ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করবে।
দেশের ওষুধশিল্পকে একটি টেকসই বৈশ্বিক ব্যবসায় পরিণত করাটা অত্যাবশ্যক। বড় বড় সংস্থাগুলো সম্ভবত এটি নিজেরা আলাদাভাবে অর্জনের চেষ্টা করছে। কিন্তু দুটো জিনিস না ঘটলে এক্ষেত্রে অনেক বেশি সময় লেগে যাবে। এক, নিয়ন্ত্রক অবকাঠামো ও প্রশাসন কার্যকর হওয়া; দুই, ওষুধ সংস্থাগুলোর নিজেদের মধ্যে ঐক্য যাতে তারা বিশ্ববাজারে, বিশেষ করে যেসব দেশে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেসব দেশে বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠায় একসঙ্গে কাজ করে।
এ কাজ দুটি না করতে পারলে দেশের ওষুধশিল্পকে বিশ্ববাজারে দাঁড় করানো অত্যন্ত কঠিন হবে।
মুরাদ হোসেন : যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির ‘পিটিসি থেরাপিউটিক্স, ইনক’-এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং গ্লোবাল রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের প্রধান