যুগ যুগ ধরে দখল হয়ে আসছে বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনীর ফুটপাত, খাল, পুকুর, জলাসয়। এ যেন দখলের মহোৎসব চলছে। দীর্ঘদিন থেকে এ অবস্থা চললেও দখলদারদের লাগাম টেনে ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়নি কখনো। বরং বছরের পর বছর ধরে বৈঠক চলছে। কিন্তু চৌমুহনীর ফুটপাত ও অবৈধ ভাবে দখল করা খাল উদ্ধার হচ্ছেনা। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দপ্তর একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শত শত বছরের পুরনো শহর চৌমুহনী। এটি বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র আর দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পর ৩য় বৃহত্তর বাণিজ্যিক কেন্দ্র এই চৌমুহনী। চৌমুহনীর যানঝট দূরীকরণে বছরের পর বছর জেলা, উপজেলা ও পৌর প্রশাসন নানা উদ্যোগ গ্রহন করে। চলে নানা ধরনের আলোচনা সভা, সমাবেশ, সেমিনার। এসব সভায় সভায় যানজট নিরসনে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও কার্যত তা মাঠ পর্যায়ে কার্যকর হয়না। রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনের অজুহাতে কঠোর কোন ভূমিকা নেয়া যায়না। ফলে বার বার সিদ্ধান্ত হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। চৌমুহনী শহরের অধিকাংশ ফুটপাত দোকানদারদের দখলে। তারা দোকানের সামনের ফুটপাটে বিভিন্ন জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখে। তার পর প্রধান সড়কের একাংশে কাচা বাজার, ভ্রাম্যমান হকার বসে। তার উপর অটোরিক্সা, সিএনজিতো সড়কের উপরেই দাড়িয়ে থাকে। ফলে মানুষ হাটা চলা করা অনেকটা দায় হয়ে পড়ে। মাঝে মধ্যে ফুটপাত দখল মুক্ত করতে প্রশাসন অভিযান চালালেও দুই একদিন পর তা আবার আগের অবস্থায় চলে আসে। স্থানীয় সচেতন মহল বলছেন, যানজটের অন্যতম কারণ ফুটপাত দখল। দোকানদাররা তাদের দোকানের সামনে জিনিসপত্র না রাখলে এতো বিশৃংখল পরিস্থিতি হতো না। ফুটপাত দিয়েই মানুষ নির্বিগ্নে হাটতে পারতো। শহরের এই দূরবস্থার জন্য ব্যবসায়ী সমিতি কোন ভাবেই দায় এড়াতে পারেনা। প্রতিদিন সকাল হলেই কলেজ রোড, রেল গেইট, করিমপুর রোড, পূর্ব বাজার, ডিবি রোডে যানজটের সৃষ্টি হয়। তখন অবর্ননীয় দুর্ভোগের শিকার হয় সাধারণ মানুষ। চৌমুহনী শহর পার হতে ৫ মিটিটের রাস্তায় ১ ঘন্টা লেগে যায়। এর জন্য দায়ী ফুটপাত দখল। ফুটপাত থেকে ভ্রাম্যমান হকারদের উচ্ছেদ করে তাদের পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা গেলে যানজটে পড়তে হবেনা মানুষকে। অপরদিকে শত বছরের পুরনো সমস্যা নোয়াখালীর উত্তর অঞ্চল বিশেষ করে বেগমগঞ্জ উপজেলার জলাবদ্বতা। বেগমগঞ্জের এ জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে পাকিস্তান আমল থেকে নানা নামে প্রকল্প গ্রহন করা হলেও আলোর মুখ দেখেনে কোনটিই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চৌমুহনীর দক্ষিণ বাজার, পূর্ব বাজার, বড় পোল, কলেজ রোড এলাকায় প্রভাবশালী মহল বছরের পর বছর ধরে সরকারী খাল দখল করে বহুতল ভবন, কল কারখানা নির্মাণ করে ব্যবসা বাণিজ্য করে আসছেন। বিগত যৌথ বাহিনীর সময় খাল খনন প্রকল্প চলাকালে প্রভাবশালী মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপে চৌমুহনীর খাল পুরো খনন করা যায়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাগজে কলমে চৌমুহনীর এই অংশটি খনন দেখালেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অভিযোগ রয়েছে, চৌমুহনীর সাবেক তহসিলদার বোরহান উদ্দিনসহ প্রশাসনের একটি চক্র চৌমুহনীতে খালের পড় প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দেন। তারা অল্প জায়গা ইজারা নিয়ে খালের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নেয়। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ বিগত সময়ে চৌমুহনী মদন মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের মার্কেটের নামে খালের উপর বহুতল হাউজিং নির্মাণ করা হয়েছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে উক্ত হাউজিংসহ চৌমুহনী-সাতারপাইয়া খালের উপর নির্মিত ভবন অপসারন ও বর্জ পরিস্কার করার জন্য ইতিমধ্যে মন্ত্রনালয় থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। তবে খালের উপর হাউজিং নির্মানের অভিযোগ অস্বীকার করে চৌমুহনী মদন মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রশিদ তারেক জানান, খালের উপর নয় স্কুলের জায়গাতেই হাউজিং নির্মাণ করা হয়েছে। বেগমগঞ্জ নাগরিক ফোরামের আহবায়ক এস এম সাহাব উদ্দিন জানান, বেগমগঞ্জ তথা জেলার উত্তরাঞ্চলকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ও চৌমুহনী শহরে যানজট নিরসনে প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের স্বদিচ্ছা দরকার। ইতিমধ্যে আমরা সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন ও ডিসি, ইউএনও মহোদয়কে ম্মারক লিপি দিয়েছি। চৌমুহনী খালের কিছু অংশ পরিস্কারও করা হয়েছে। কিন্তু বরাদ্ধ না থাকায় কাজ বন্ধ আছে। আমরা সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। চৌমুহনীতে ফুটপাত ও খাল দখলের বিষয়ে চৌমুহনী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হুমায়ুন কবির জানান, আমাদের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে সব সময় সহযোগীতা করে আসছি। প্রশাসন যেই উদ্যোগ নেবে আমরা তা বস্তবায়নের চেষ্টা করবো। এদিকে বিগত সরকারের আমলে নোয়াখালীর খাল খনন প্রকল্পের ৩ শ কোটি টাকাও কাজে আসেনি। চৌমুহনী পৌরসভার সচিব জাকির হোসেন জানান, আমরা সর্বত্মক চেষ্টা করছি চৌমুহনী শহরের যানজট নিরসনে। ভ্রাম্যমান হকারদের পূনর্বাসনসহ বিভিন্ন দিকে নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা হয়েছে। চৌমুহনী পৌসভার বর্তমান প্রশাসক ও বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আরিফুর রহমান জানান, চৌমুহনী শহরে যানজট নিরসন, বন্যা, জলাবদ্ধতা দূরিকরনে খাল পরিস্কার, অবৈধ দখলমুক্ত করন এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছি। বিভিন্ন সুশিল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা হচ্ছে। আমাদের ডিসি স্যারও আলোচনা করেছেন। সকলের সহযোগীতা পেলে আমরা দীর্ঘদিনের এই দুটি সমস্যা সমাধান করতে পারবো বলে আশা করছি। এ জন্য বেগমগঞ্জবাসীকে আরো সচেতন হওয়ার আহবান জানান তিনি। খাল দখল ও অপরিস্কারের বিষয়ে নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুন্সী আমির ফয়সল জানান, খাল পরিস্কার রাখা আমাদের দায়ীত্ব নয়, এটি পৌর এলাকায় পৌরসভার দায়ীত্ব। দোকান পাটের বজ্র খালে পেলা হচ্ছে, ফলে দিন দিন খাল অপরিস্কার হয়ে নালায় পরিণত হচ্ছে। পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে আমরা সরকারের বরাদ্ধ অনুযায়ী খাল খনন করে থাকি। এ ক্ষেত্রে পৌরসভাকে আরো দায়ীত্বশীল হতে হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। অপরদিকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর নবাগত জেলা প্রশাসক ইফতেখার আলম এলাকার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে চৌমুহনী পাবলিক হলে এক মতবিনময় সভা করে এলাকার যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়ে আলোচনা করেন। সেখানে তিনি বেগমগঞ্জে যানজট ও জলাবদ্ধতা দুরিকরনে সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।